Wednesday, June 4, 2025
spot_imgspot_img

Top 5 This Week

spot_img

Related Posts

পুলিশি তলব এড়িয়ে যেতে দ্বিতীয় বারও ‘‌অসুস্থ’‌ ! আবার গ্রেফতার কেষ্ট?‌এফআইআর বীরভূমের ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের নামে!

এবার রাজ্য পুলিশের হাতেই গ্রেফতার এড়াতে মরিয়া চেষ্টা এক দশক ধরে ‘কেষ্ট’ নামের ইজারা নেওয়া বীরভূমের ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের। দোর্দণ্ডপ্রতাপ কেষ্ট মণ্ডলকে জেলা সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে বরখাস্ত। প্রভাবশালীর নির্ভুল নির্দেশে পটভূমিতে ফিরে এসেছে পরিচিত ‘চড়াম-চড়াম’ আওয়াজের বদলে ‘‌পালা রে কেষ্ট’‌ স্বর। কেষ্ট মণ্ডলের রাজনৈতিক অভিযাত্রা দেখে নিজেরই মাঝেমধ্যে অবাক লাগে। মাথার কদমছাঁট চুল, ঘন ভ্রু, ঝুঁপো গোঁফ, মোটা ঠোঁট, ঢোলা ফতুয়া-পাজামা, আঙুলে গ্রহরত্ন সমন্বিত আংটির ভিড় আর মাঠো কথা ‘ডায়ালগ’ গরম লুচির মতো পাতে পড়লেই হিট। গ্রাম্য বাহুবলীর আদর্শ উদাহরণ। হাতের দশ আঙুলে সম্ভবত খানাষ্টেক। বুড়ো আঙুলে পরা যায় না। কোনও কোনও আঙুলে একাধিক পাথর-বসানো আংটি। ঢিলেঢালা হাফহাতা কুর্তা আর পাজামা। গলায় একাধিক হার-মালা-চেন, ডানহাতের কব্জিতে বাঁধা হরেক কিসিমের মন্ত্রপূত তাগা। ঝকঝকে রিস্টলেট। বাঁ-হাতের মণিবন্ধে মেটাল স্ট্র্যাপের দামি ঘড়ি। সব মিলিয়ে অনুব্রতের একটা বাঘা উপস্থিতি। সামনে দাঁড়ালে স্নায়ু নিজের বশে থাকে না। কাপড়চোপড় নষ্ট হওয়ার অবস্থা হয়। মেরুদণ্ড বেয়ে একটা তিরতিরে ভয়ের স্রোত নামতে থাকে। কোনও দিন জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ সাংসদ, বিধায়ক তো দূরের কথা, পঞ্চায়েতের পদাধিকারীও না। অথচ বোলপুরের রাজনীতিতে কী দাপট! অবশ্য সেই প্রভাব না-থাকলে তৃণমূল দলের ‘‌উপরওয়ালা’‌ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত শুধু শুধু এত নম্বর দিয়ে কেষ্টর মাথার উপর থাকে?‌ ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগের বিখ্যাত ‘খেলা হবে’ স্লোগানের কপিরাইটও নাকি বীরভূমের এই বাহুবলীর। তার পর তা ছড়িয়ে পড়ে দিগ্‌দিগন্তে। এমনকি, মমতাও নিয়মিত ব্যবহার করতে থাকেন সেই ‘কেষ্ট-বাণী’।

কেষ্ট ঘনিষ্ঠদের বুজরুগি শুরু!‌ এআই প্রযুক্তিতে ‘তৈরি’ কেষ্ট-কণ্ঠ?‌ আইনজীবী জানান, অনুব্রত অসুস্থ। পুলিশকে অশ্লীল ভাষার প্রয়োগে হুমকি। মামলায় এফআইআর হয়েছে বীরভূমের ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে। শনিবার ৩১ মে, বেলা ১১টায় তাঁকে এসডিপিও অফিসে হাজিরা দিতে বলে পুলিশ। হাজিরায় সাড়া নেই অনুব্রতর। বদলে আইনজীবীরা এসডিপিও অফিসে যান। দ্বিতীয় বার পুলিশের তলব। ফের বোলপুর এসডিপিও অফিসে হাজিরা হল না অনুব্রত মণ্ডল ওরফে কেষ্টর। ঘনিষ্ঠদের সূত্রে জানা যায়, তৃণমূল নেতার এক আইনজীবী এবং এক ঘনিষ্ঠ এসডিপিও অফিসে পৌঁছে, ইঙ্গিত দেন ১জুন, রবিবারও ‘আসতে পারছেন না’ কেষ্ট। অথচ, পুলিশকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ ও হুমকি মামলায় এফআইআর দায়ের বীরভূমের ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে। এসডিপিও অফিসে বারবার হাজিরা এড়িয়ে যেতে অনুব্রতর আইনজীবীরা এসডিপিও অফিসে গিয়ে মক্কেলের শারীরিক অসুস্থতা এবং আরও কয়েকটি কারণ দর্শিয়ে তাঁরা জানান, শনিবার অনুব্রতের পক্ষে হাজিরা দেওয়া সম্ভব নয়। অনতিবিলম্বে পুলিশের দেওয়া দ্বিতীয় নোটিসে বলা হয়, রবিবার বেলা ১১টার মধ্যে বোলপুর এসডিপিও অফিসে হাজিরা দিতে হবে তৃণমূল নেতাকে। পুলিশের নির্ধারিত সময়ের পরে কেষ্টর এক ‘ঘনিষ্ঠ’ বলেন, ‘‘দাদার শরীর খারাপ। তবে দুপুরে উনি যেতে পারেন এসডিপিও অফিস।’’বেলা ১১টা নাগাদ এসডিপিও অফিসে যান কেষ্ট-ঘনিষ্ঠ গগন সরকারের সাজানো নতুন একটি দাবি, ‘‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অর্থাৎ এআই ব্যবহার করে ওই অডিয়ো ক্লিপটি পাঠানো হয়েছে।’’

পুলিশি তলবে সাড়া না দিলেও নিত্যদিনের মতো বোলপুরে দলীয় কার্যালয়ে উপস্থিত অনুব্রত। বোলপুর তৃণমূল কার্যালয় রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিন্‌হা জানান, ‘‘কোনও মিটিং ছিল না আজ শনিবার। অনুব্রতের শরীর খারাপ। তাই দেখতে এসেছিলাম। নিশ্চয়ই আগামিকাল উনি যাবেন।’’ সাড়ে ১১টা নাগাদ অনুব্রতের ঘনিষ্ঠ গগন এসডিপিও অফিস থেকে বেরিয়ে বলেন, ‘‘উনি বাড়িতে আছেন। বিছানায় আছেন। শুয়ে আছেন। যা জানার পুলিশের কাছে জেনে নিন। আর পার্টির নির্দেশে অনুব্রত চলেন। তিনি অনুগত সৈনিক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৈনিক। পুলিশের অভিযোগ তারা দেখবে। তদন্ত হবে।’’ অনুব্রতের আইনজীবী বিপদতারণের বক্তব্যে ইঙ্গিত, দ্বিতীয় বার পুলিশি তলব এড়িয়ে তৃণমূল নেতার হাজিরা দেওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা। কেষ্টর আইনজীবী বলেন, ‘‘চক্রান্ত করে ফাঁসানো হয়েছে অনুব্রত মণ্ডলকে। উনি অসুস্থ বলে পুলিশকে জানানো হয়েছে। তবে তদন্তে সহযোগিতা করবেন অনুব্রত।’’ পুলিশি হাজিরা এড়িয়ে কেষ্ট আগাম জামিনের আবেদন করবেন? আইনজীবী এই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে বার বার বলতে থাকেন, চক্রান্ত করে ফাঁসানো হয়েছে অনুব্রতকে। চক্রান্ত করছেন কে, কেনই বা চক্রান্ত করেছেন, স্পষ্ট করতে সক্ষম হননি কেষ্টর আইনজীবী।

গরুপাচার মামলায় ২০২২ সালের আগস্টে কেষ্ট বোলপুরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার সিবিআইয়ের হাতে। তার পর থেকে জেলে বন্দিজীবন। প্রথমে আসানসোল জেল। তার পর দিল্লির তিহাড়। সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর আসানসোল জেলের মধ্যে ইডি-ও গ্রেফতার করে ইডি-র হেফাজতে রেখেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয় ২০২৩ সালের মার্চ মাস। দিল্লিতে ইডি-র সদর দফতরে কয়েক দিন রেখে জেরা। ৮ মার্চ থেকে তিহাড় জেলে বন্দি কেষ্ট। ২০২৩ সালেরই এপ্রিলে ইডি-র হাতে গ্রেফতার কেষ্ট কন্যা সুকন্যা মণ্ডল। দিল্লিতে ডেকে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার। গরুপাচার মামলার তদন্তে দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালতে কেষ্টর বিরুদ্ধে দায়ের করা চার্জশিটে ইডি জানিয়েছিল, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ এবং নামে-বেনামে সম্পত্তি মিলিয়ে কেষ্টর ৪৮ কোটি টাকার বেশি সম্পদের হদিস মিলেছে। ইডি-র বক্তব্য অনুযায়ী যার পুরোটাই গরুপাচারের ঘুষের টাকায় তৈরি। রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক প্রভাব খাটিয়ে এনামুল হকের গরুপাচার মসৃণ ভাবে চালানোর ব্যবস্থা হত কেষ্টর হাত দিয়েই। তার বিনিময়ে কোটি-কোটি টাকা অর্থাৎ কেষ্টর কাছের লোকেদের ভাষায় ‘সার্ভিস চার্জ’ জমা পড়ত অনুব্রতর সিন্দুকে। বোলপুরের নিচুপট্টির বাড়ির পরিচারক বিদ্যুৎবরণ গায়েনের নামে ছিল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। অথচ তার ‘নমিনি’ কেষ্টর মেয়ে সুকন্যা! মাসিক ১৫ হাজার টাকা বেতন পেতেন বিদ্যুৎ। আবার এই ১৫ হাজার টাকা বেতনের কর্মীর নামে কেনা হয়েছিল ৭ কোটি ৭১ লক্ষ টাকার জমি। ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল আনাজবিক্রেতা এবং ধোপা বিজয় রজকের নামে। মাঝেমধ্যেই যাঁর ডাক পড়ত কেষ্টর গা-হাত-পা মালিশের জন্য। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিউড়িতে সভা ছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতার। কেষ্ট তখন জেলে। সেই সভায় মমতা বলেছিলেন, বীরভূমে চক্রান্ত চলছে! প্রকাশ্য সভা থেকে কেষ্টকে সার্টিফিকেট দিয়ে মমতা বলেছিলেন, ‘‘কেষ্টকে কত দিন ধরে জেলে ভরে রেখেছে। কিন্তু মানুষের মন থেকে ওকে দূর করতে পারেনি। আসতে আসতে দেখছিলাম, তরুণ প্রজন্ম ওর কথা বলছে। আমি তো কাউকে শিখিয়ে দিইনি। কিন্তু আমি মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখছিলাম। ও কাজ করেছে, ও কাজ করতে জানে।’’

পোড়খাওয়া রাজনীতিক মমতা জানতেন, দল চালাতে গেলে হার্ভার্ডের অধ্যাপক সুগত বসুকে যেমন দরকার, তেমনই প্রয়োজন কেষ্ট মণ্ডলদেরও। সুগতেরা হবেন ‘নাগরিক মুখ’। কেষ্টরা গ্রামেগঞ্জে সংগঠন সজুত করবেন। সুগতেরা যাবেন সংসদে গণতান্ত্রিক বিতর্কে অংশ নিতে। আর কেষ্টরা নরমে-গরমে, ধমকে-চমকে, টানে-ঢিলে ভোট করাবেন। কোথাও নকুলদানা দেবেন। কোথাও গুড়-বাতাসা। দিদি যা বলবেন, অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন। কালের পাশায় উল্টো দান পড়ে গেল। বীরভূম জেলায় কেষ্টর অনুপস্থিতিতে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে অবতীর্ণ হল তৃণমূল। দু’টি আসনই হইহই করে জিতল। সম্ভবত তখন থেকেই কেষ্টর মাথার কলপহীন চুল এবং গোঁফের মতো তাঁর রাজনৈতিক দাপটের রংও ফিকে হতে শুরু করেছিল। স্বাভাবিক। জীবনের মতো রাজনীতিতেও কখনও কোনও শূন্যতা থাকে না। কারও ফেলে যাওয়া জায়গা ফাঁকা থাকে না। সামান্য সুযোগ পেলেই বিকল্প ক্ষমতা লকলক করে মাথা তুলে দাঁড়ায়। বীরভূম ব্যতিক্রম হতে যাবে কোন দুঃখে? কেষ্টর স্থানও শূন্য থাকেনি। যাঁরা ছুঁচ হয়ে ঢুকেছিলেন, কেষ্টর অনুপস্থিতিতে তাঁরাই ফাল হয়ে উঠলেন।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তিহাড় থেকে মুক্ত কেষ্ট। জামিন দিল দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালত। আইনি কাগজপত্র সময়ে জমা না-পড়ায় তাঁর সত্বর জেলমুক্তি সম্ভব হয়নি। পরে নথিপত্র ঠিকঠাক জমা পড়ায় জামিন পান। বাবাকে জেল থেকে আনতে গিয়েছিলেন সুকন্যা। সেপ্টেম্বরের শেষে মেয়েকে নিয়ে বোলপুরের নিচুপট্টির বাড়িতে ফেরেন অনুব্রত। কলকাতা বিমানবন্দর থেকেই কেষ্টদের সঙ্গী হয়েছিল পুলিশ। হাজার হোক, রাজ্য সরকারের তরফে নিরাপত্তা বরাদ্দ থাকে কেষ্টর জন্য। বাড়ি ফিরে কেষ্ট-‌কথা, পা এবং কোমরে ‘বেদনা’ আছে। পরের দিনই পুলিশকর্মীর কাঁধে ভর দিয়ে তৃণমূল কার্যালয়ে কেষ্ট। পুলিশের সঙ্গে কেষ্টর সম্পর্কের ইতিহাস প্রাচীন। কখনও অন্যদের নিদান পুলিশকে ‘বম্‌’ মারতে। কখনও কব্জির বাঘা ঘড়ি দেখিয়ে পুলিশকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার রাজা কেষ্ট। কখনও পুলিশের সঙ্গে গল্পগাছা এই কেষ্টরই। পরদিন গ্রামের বাড়িতে গিয়ে অবশ্য আরও কারও কাঁধে ভর দিতে হয়নি। সম্ভবত ঠাহর হয়েছিল, আবার নিজের পায়ে, নিজের দাপটে, নিজের চোটেপাটে দাঁড়াতে হবে নিজেকে। জীবন এবং সম্পর্কের মতো রাজনীতিতেও তার একবার কেটে গেলে তা জোড়া কঠিন। কেষ্ট জেল থেকে ফিরে এসেও রাজ্যপাট একই। কারণ, জেলে গেলেও তাঁকে বীরভূমের জেলা সভাপতি পদ থেকে সরাননি দলনেত্রী মমতা। পরে পদাবনতি। বীরভূমের জেলা সভাপতির পদ ছেঁটে ফেলে করে দেওয়া হল দল পরিচালনায় গঠিত কোর কমিটির সদস্যমাত্র। কেষ্ট গলায় তখন নম্রতা। নম্রতাটা নিছক নির্মোক। দীর্ঘলালিত ‘চড়াম-চড়াম’ গুমোর অত সহজে চলে যায় না। কেউ যেতে দিতেও চায় না। ক্ষমতা এক আশ্চর্য বস্তু। নিষিদ্ধ বলবর্ধক পাঁচনের মতো। নিষিদ্ধ। কিন্তু বলবর্ধক। সেই অনুপান যে এক বার খেয়েছে, তার সব বেভুল হয়ে যায়। আগুপিছু, গুরু-লঘু জ্ঞান লোপ পায়। ক্ষমতার লেজ যখন কেউ মাটিতে আছড়ানো শুরু করে, তখন সে ভুলে যায়, সে লেজ কাটাও পড়তে পারে।

পুলিশি তলব। একের পর এক তলব। সময় পেরিয়ে গেল, হাজিরায় না কেষ্টর! বোলপুরে এসডিপিও অফিসে গেলেন অনুব্রতের সাত আইনজীবী। বোলপুরের পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গে ফোনে তাঁর কথোপকথনের অডিয়ো শুনতে শুনতে কান-মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করছিল। গা ঘিনঘিন করছিল। দু’-চারটে অসংসদীয় শব্দ। যা সচরাচর কেউ বন্ধুবৃত্তে বা লঘু আড্ডায় ব্যবহার করে না। একটু প্রগল্‌ভ। একটু আদিরসাত্মক। একটু বাচাল। কেষ্ট মণ্ডল সে সবের সীমা অতিক্রম করে অভ্যস্ত অবলীলায় অশ্লীল শব্দের এমন অনায়াস ব্যবহারে পটু। এক পুলিশ অফিসারের মা এবং স্ত্রীকে জড়িয়ে যে সমস্ত বাক্য কেষ্টর মুখে শোনা গেছে, তা লেখার সাহস জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সিরিজের ডাকাবুকো চিত্রনাট্যকারেরাও দেখাতে পারবেন কি না সন্দেহ! বৃষ্টির ছাটের মতো কেষ্টর মুখনিঃসৃত অশ্রাব্য শব্দ এবং বাক্য ছাপার অযোগ্য শোনাতে গেলে ‘বিপ’ শব্দও লজ্জায় মুখ লুকোবে তো বটেই, অসুস্থ করে দেওয়ার পক্ষেও যথেষ্ট। ‘ওষুধ’ সংক্রান্ত কেষ্টর স্খলিত কণ্ঠ, প্রতাপশালীর রোয়াব এবং তজ্জনিত চোটপাট যে তলানিতে গোটা বিষয়টাকে নিয়ে ফেলেছে, তার নজির সাম্প্রতিক কালে নেই। একজন দায়িত্বশীল প্রশাসনিক অফিসারকে যে ভাষায় এবং যে ভঙ্গিতে হুমকি। অডিয়োটা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল ‘হুমকি’ও যথেষ্ট নরম শব্দ। নিজেও সটান বুঝে বলা যে, ফোনকলটি যে রেকর্ড হচ্ছে, সে কথা সম্যক জেনেই ওই কথাগুলো উচ্চারণ। ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়েছে এক বেপরোয়া এবং উন্মার্গগামীর দম্ভ। দৃষ্টান্তমূলক প্রশাসনিক শাস্তির বদলে দলের তরফে শো কজ করার হুঁশিয়ারি এবং তার পরে কুৎসিত বানানে মেকি ক্ষমাপ্রার্থনার বাণীতে শাস্তির চিঁড়ে ভিজে গেলে তার কুফল সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য।

বঙ্গীয় রাজনীতিতে এমন চরিত্র বিরল। বিরলতমও বলা যায়। সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেল খেটে আসা নেতা বাংলার রাজনীতিতে আর নেই। ওজনদার এবং সতত দোদুল্যমান চেহারা। কখনও ঢুলুঢুলু আবার কখনও গুলিভাঁটার মতো চোখ। লোকটা আগুপিছু না-ভেবে প্রকাশ্য সভায় বিনাদ্বিধায় বলতে পারে, ‘‘পুলিশের গাড়িতে বম্ মারুন’‌’‌ ‘বোম’ নয়, ‘বোমা’ও নয়। গ্রামীণ হাটুরে ভাষায় ‘বম্’ মারুন! আমি বলছি, বম্ মারুন!’’ ‘‘শুঁটিয়ে লাল করে দেব!’’ ‘‘ওরা বিরোধীরা ইঁদুরের বাচ্চা। শান্তিতে থাকতে হলে ওদের বিষ দিয়ে মারুন!’’ ‘‘চোখ রাঙাবেন না। চোখ তুলে নেব!’’‘‘কব্জি কেটে নেব!’’ ‘‘প্রশাসন আমাদের প্রতি অবিচার করেছে। কোনও নির্দল প্রার্থীকে ভোট দেবেন না। কোনও নির্দল প্রার্থী হুমকি দিলে তার বাড়িটা ভেঙে, জ্বালিয়ে দিন!’’ ‘‘ওই বিজেপির মেয়েটা তো? ওকে একটা গাঁজা কেস দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দে!’’ এক দঙ্গল লোকের মাঝে দাঁড়িয়ে পুলিশ অফিসারকে কব্জির ঘড়ি দেখিয়ে বলতে পারে, ‘‘এখন আমার ঘড়িতে সওয়া ৪টে বাজে। ৮টার মধ্যে ওরা যদি অ্যারেস্ট না হয়, আমি ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটিয়ে দেব! কোনও কাহিনি শুনব না। ভয়ঙ্কর খেলা খেলে দিয়ে যাব! সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেব!’’ বোলপুর থানার আইসির মা-স্ত্রীর উদ্দেশে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ।

গ্রাম্য, হেটোমেঠো এবং অতিকথন দোষে দুষ্ট। জিহ্বার উপর লেশমাত্র নিয়ন্ত্রণ নেই। পারিবারিক মশলাপাতির ব্যবসা ছিল। তিন ভাইয়ের মধ্যে মধ্যমকে সেই দোকানে বসতে দিয়েছিলেন বাবা। চাল-ডাল-মশলার মণিহারি দোকান। বীরভূমের স্থানীয় ভাষায় ‘লটকন’-এর দোকান। বোলপুরের নিচুপট্টিতে তাঁদের পারিবারিক ভদ্রাসনটি একদা নাকি ‘মশলাবাড়ি’ বলে পরিচিত ছিল। লেখাপড়া কম। জনশ্রুতি, ক্লাস এইট পাস। একটা সময়ে মাছ কেনাবেচার ব্যবসা। নিজের হাতে আঁশবঁটিতে মাছ কেটেছে। আর জমির দালালি। একদা এই ছিল অনুব্রতের আয়। এরকম লোকই তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাই। দরকারে উল্টোদিকের লোকটার কলার চেপে ধরবে বা সটান ঠাটিয়ে একটা চড় মেরে দেবে। এই লোকের আপনি-তুমির জ্ঞানগম্যি থাকবে না। সেই কারণেই সে রাজ্যসভার সাংসদ হতে চাইবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উবাচ। ভোটেও দাঁড়াতে চাইবে না। কারণ, লোকটা আসলে রাজনীতিক নয়। নেতা নয়। নেতা বা রাজনীতিকের মতো সাবধানী নয়। এই লোক মেপে কথা বলবে না। এই লোক ঠাকুরদেবতায় অপার বিশ্বাসী থাকবে। স্ত্রীবিয়োগে ভেঙে পড়বে। কন্যার ব্যাপারে অসম্ভব স্নেহপ্রবণ থাকবে। মুখের কথাটি খসাতে না খসাতে মেয়ের কাছে তার ঈপ্সিত বস্তু পৌঁছে দেবে। এই লোককে গ্রামের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বলা যাবে, বিপদে পড়েছি। একটু সাহায্য করে দিন কেষ্ট’দা। প্রথম থেকেই ‘দিদিভক্ত হনুমান’। যত না ‘দল’ করেন, তার চেয়ে বেশি ‘দিদি’ করেন। মমতা যদি বলেন সাত তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে, অনুব্রত চোখের পলক না-ফেলে সেটাতেই রাজি। কারণ, কেষ্টর স্থির বিশ্বাস, দিদি নীচে জাল পেতে রেখেছেন!

দিদি-সঞ্জীবনীতে ভরসা অনুব্রতর। এখনও। ওই একটি খোঁটাতেই চিরকাল বাঁধা। খোঁটা বদলায়নি। খুঁটিও বদলায়নি। ঘোর দুর্বিপাকেও মমতা প্রকাশ্যে কেষ্টর পাশে দাঁড়িয়েছেন। বরাবরই হাঁকের লোক, ডাকের লোক, দাপের লোক। রাজ্যে ‘পরিবর্তন’-এর পর থেকে অনুব্রত ঠাটেরও লোকটির জানা আছে, কী ভাবে নিরঙ্কুশ ভোট জিততে হয়। কী ভাবে সংগঠন হাতের মুঠোয় রাখতে হয়, কী ভাবে দলের অন্দরে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে দাবিয়ে রাখতে হয়, সময় বুঝে কোথায় কোথায় গুড়-বাতাসা বা নকুলদানা বিলি করতে হয়। রাজ্যে তৃণমূলের সরকার ক্ষমতায় আসার পর লাফিয়ে লাফিয়ে অনুব্রতের সম্পত্তি বেড়েছে। সবই বিচার এবং প্রমাণসাপেক্ষ। সিবিআই অনুব্রত সম্পর্কে সরাসরি অভিযোগ এনেছে, বীরভূম জেলায় যত বেআইনি বালিঘাট, পাথরখাদান আছে, তার আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত অনুব্রতের ঘনিষ্ঠ সহগল-লতিফরা। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা গরুপাচারের সঙ্গেও জড়িয়ে অনুব্রত বদলে-যাওয়া অনুব্রত। এই অনুব্রত কানে বেশি দেখে। চোখে বেশি শোনে। এই অনুব্রতের জীবনে এসেছিল দাপট এবং প্রতিপত্তি বৃদ্ধির নির্ভূল সূচক। নিজের ফোনটি পার্শ্ববর্তী টেনিয়াদের হাতে দিয়ে রাখা। ব্যস্ত ‘দাদা’ কি আর সব ফোন ধরবে! অনুব্রতর চ্যালা বাপি আসলে কেষ্টর ‘টেনিয়া’। ‘স্যাটেলাইট’। সঙ্গে সঙ্গে থাকে। কেষ্টর আলোয় আলোকিত হয়ে তাঁর ক্ষমতার কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। যে লোকটা কব্জি কাটার হুমকি দেয়, সে আবার ফাঁদে পড়ে কাঁদে কেন! কেন সিবিআই বারবার ডাকলেও যায় না? উল্টে ফিশচুলা-জাতীয় বিজাতীয় সব অসুখের নাম করে সরকারি হাসপাতালের কেবিনে সেঁধিয়ে যায়? কেন্দ্রীয় বাহিনী যখন বাড়ি ঘিরে ফেলেছে, তখন সে ঠাকুরঘরে গিয়ে দোর দেয় কেন? অনুব্রতও ব্যস্ত। ফোন ধরতে শুরু করল হয় নিরাপত্তারক্ষী বা আমচা-চামচারা। তারা লোক বুঝে ‘দাদা’-কে ফোন দিত। এই লোক আপাতদৃষ্টিতে ভীতিজনক হলেও একটু কাছা-আলগা হবে। চারপাশের লোকের উপর বিশ্বাস করবে। কাউকে বিশ্বাস করবে নথিপত্র সামলে-সুমলে দেওয়ার জন্য। কাউকে বিশ্বাস করবে আর্থিক লেনদেনের জন্য। আর বিকারগ্রস্তের মতো সম্পত্তি বাড়িয়ে যাবে। বাড়িয়েই যাবে। ‘দিদিভক্ত হনুমান’ অনুব্রত ‘নেতা’ না। অনুব্রতএকজন ‘দলপতি’। গোষ্ঠীপতি। দলপতি বিপাকে পড়লে চারপাশের আলোগুলো একে একে নিভে যেতে থাকে। খুব ম্যাড়ম্যাড়ে মনে হতে থাকে। কারণ, সেটাই সত্য। আর কে না জানে যে, বেশিরভাগ সত্যই ম্যাড়ম্যাড়ে, অনুজ্জ্বল এবং সাধারণ হয়। দলপতি অনুব্রতকে ঘিরে সেই বিচ্ছুরণটা ফিকে হতে শুরু করে। আশেপাশের আলোগুলো কি নিভে যেতে শুরু করে?

ইতিমধ্যে অনুব্রতের পাল্টা ‘মুখ’ হিসাবে বীরভূমের রাজনীতিতে মাথা তুলেছেন কাজল শেখ। ভাইরাল হওয়া অডিয়ো ক্লিপে ‘অনুব্রত’ বিবিধ ‘বিশেষণ’ উল্লেখ করে বোঝাতে চান বোলপুরের আইসি ‘কাজল’-এর লোক। পাল্টা উল্টো দিকের কণ্ঠস্বরকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আমরা কারও লোক নই।’’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Popular Articles