লাল মাটির রানি। ফরাসি ওপেনের নতুন রানি কোকো গফ। মহিলাদের ফাইনালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গফ ৬-৭ ৫-৭, ৬-২, ৬-৪-এ হারান সাবালেঙ্কাকে। ফরাসি ওপেন পেল নতুন মহিলা চ্যাম্পিয়ন। ২১ বছর বয়সি এই মার্কিনীর দ্বিতীয় খেতাব। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ওপেন জিতেছিলেন কোকো। সেবারও ফাইনালে হারান সাবালেঙ্কাকে। ২০২২ সালে ফরাসি ওপেনের ফাইনালে হেরে যান কোকো। সাবালেঙ্কাকে হারানোর পরে স্ট্যান্ডে মা-বাবার সঙ্গে নাচে মেতেছিলেন কোকো। ম্যাচ হারানোর শোকে সাবালেঙ্কা তখন কাঁদছেন। গফের আগে সর্বশেষ মার্কিন খেলোয়াড় হিসেবে ফরাসি ওপেন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন সেরিনা উইলিয়ামস। ২০১৫ সালের ফাইনালে চেক প্রজাতন্ত্রের লুসি সাফারোভাকে হারিয়ে তৃতীয়বার ফরাসি ওপেনের রানি হয়েছিলেন সেরিনা। এই দুই তারকা ১০ বার মুখোমুখি হয়েছিলেন। দু’জনই পাঁচ বার করে জেতেন। এবারের লড়াইয়ে কোকো জিতলেন। এর আগে তিন বছর এই ট্রফি দখলে থাকা ইগা শিয়নটেককে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছেছিলেন সাবালেঙ্কা। ক্লে কোর্ট পছন্দের নয়। সেই ক্লে কোর্টেই কোকো টেক্কা দিয়ে গেলেন সাবালেঙ্কাকে। প্রথম সেটে শুরুটা দুর্দান্ত করে সাবালেঙ্কা এগিয়ে গিয়েছিলেন ৪-১ গেমে। সেখান থেকে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে টাইব্রেকারে নিয়ে যান সেট। প্রথম সেট কোকো হেরে গেলেও দ্বিতীয় সেটে সাবালেঙ্কাকে দাঁড় করিয়ে হারান। তৃতীয় সেটে মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিলেন বেলারুশের তারকা। মোক্ষম সময়ে তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে র্যাকেট। কোকো গফ শান্ত। চাপ অনুভব করেননি। ম্যাচ জেতার পরে ক্লে কোর্টে শুয়ে পড়েন মার্কিন তরুণী। হেরে গিয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি বেলারুশের তারকা। কেঁদে ফেলেন। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললেন, ”কোকো আজ তুমি আমার থেকে ভাল খেলেছো।” দূরে শান্ত ভাবে বসে আছেন কোকো গফ। নতুন রানি পেল লাল সুড়কি। ফরাসি ওপেন চ্যাম্পিয়ন হলেন আমেরিকার ২১ বছরের তারকা কোকো গফ। তিন সেটের রুদ্ধশ্বাস লড়াই শেষে গফের কাছে হার মানলেন আরিয়ান সাবালেঙ্কা।

‘ভিক্টরি বিলংস টু দ্য মোস্ট টেনাসিয়াস’। ফিলিপ শঁতিয়ে কোর্টে লেখা এই আপ্তবাক্যের অর্থ, প্রতিকূলতার মধ্যেও যে লড়াই ছাড়ে না, জয় তারই হয়। সেটাই করে দেখালেন কোকো গফ। পিছিয়ে পড়েও লড়াই ছাড়লেন না। প্রথম সেট হেরেও লড়াই ছাড়লেন না। টেনিস সার্কিটে সাবালেঙ্কার চিৎকার বিখ্যাত। তাঁর প্রতিটা শটের পরেই সেই চিৎকার শোনা যায়। যত সময় গড়াল সেই চিৎকার বাড়ল। আনন্দে নয়, হতাশায়। সাবালেঙ্কার চিৎকার থামিয়ে দিলেন গফ। জিতে নিলেন নিজের প্রথম ফরাসি ওপেন। ২০২২ সালের ফাইনালে ইগা শিয়নটেকের কাছে হারতে হয়েছিল। আড়াই ঘণ্টায় তিন সেটের লড়াই ৬-৭, ৬-২, ৬-৪ জিতলেন। সেরিনা উইলিয়ামস ১০ বছর আগে ফরাসি ওপেন জিতেছিলেন। ১০ বছর পর আবার কোনও আমেরিকান খেলোয়াড়ের হাতে উঠল এই ট্রফি। ২০২৩ সালের ইউএস ওপেনের রিপ্লে দেখা গেল এ বারের ফরাসি ওপেনে। সে বারও প্রথম সেট হেরে পরের দুটো সেট জিতেছিলেন গফ। সেটাই প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়। নিজের দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যামও তিনি জিতলেন সেই সাবালেঙ্কাকে হারিয়েই। বিশ্বের দু’নম্বরের কাছে হারতে হল এক নম্বরকে। সাবালেঙ্কা ‘পাওয়ার’ টেনিসে বিশ্বাসী। তাঁর সার্ভিস পুরুষদেরও সমস্যায় ফেলবে। সেই পাওয়ার বা শক্তিই তাঁর সবচেয়ে দুর্বলতা। এক বার ভুল করতে শুরু করলে আরও জোরে শট খেলার চেষ্টা করেন । ভাবখানা এমন, প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দেবেন। তাতে আরও বেশি ভুল করেন সাবালেঙ্কা। সেটা এই ম্যাচে দেখা গেল। একটার পর একটা ভুল তাঁকে আরও রাগিয়ে দিল। মনঃসংযোগ নষ্ট করল। সাবালেঙ্কা একটা করে আনফোর্সড এরর করছিলেন আর তাঁর কোচের দিকে তাকিয়ে হতাশা উগরে দিচ্ছিলেন। গোটা ম্যাচে ৭০টা আনফোর্সড এরর করেছেন তিনি। গফের থেকে ৪০টা বেশি। নিজের ভুলেই হেরেছেন সাবালেঙ্কা। ৯ বার তাঁর সার্ভিস ভেঙেছেন গফ। উল্টে সাবালেঙ্কা গফের সার্ভিস ভেঙেছেন ৬ বার। সার্ভিস ভাঙার খেলায় শেষ পর্যন্ত জিতেছেন আমেরিকার ২১ বছর বয়সি খেলোয়াড়। নিজের থেকে ৬ বছরের বড় প্রতিপক্ষকে হারিয়েছেন তিনি।

অথচ শুরুটা হয়েছিল সম্পূর্ণ উল্টো। বৃহস্পতিবার এই কোর্টেই চার বারের ফরাসি ওপেন চ্যাম্পিয়ন ইগা শিয়নটেকের বিরুদ্ধে যে ভাবে সাবালেঙ্কা শুরু করেছিলেন সেই এক ছবি দেখা গেল এই ম্যাচেও। শুরুতেই গফের সার্ভিস দু’বার ভাঙেন তিনি। মাত্র ১৫ মিনিটে এগিয়ে যান ৪-১ গেমে। তখন দেখে মনে হচ্ছে, ফাইনালে গফকে দাঁড়াতে দেবেন না সাবালেঙ্কা। স্ট্রেট সেটে জিতবেন। কিন্তু পিছিয়ে পড়েও লড়াই ছাড়েননি গফ। তাঁর মুখে কোনও হতাশা বা রাগ দেখা যায়নি। দু’জন সম্পূর্ণ বিপরীত। সাবালেঙ্কা যেমন কোর্টেই তাঁর সব অভিব্যক্তি প্রকাশ করে ফেলেন, গফের মুখ দেখে সে সব বোঝা যায় না। ঠিক যেন পাথরের উপর কেউ ভাস্কর্য বানিয়েছেন। চোখ দুটো উজ্জ্বল। সাবালেঙ্কার ভুলের অপেক্ষা করলেন। তার পর তাকে কাজে লাগালেন। প্রথম সেট ১-৪ পিছিয়ে থেকে টাইব্রেকারে নিয়ে যান গফ। সেখানে অবশ্য সাবালেঙ্কার পাওয়ার গেম হারিয়ে দেয় তাঁকে। গফ বুঝতে পেরেছিলেন, প্রথম সেটেই নিজের বেশির ভাগ শক্তি ব্যয় করে ফেলেছেন সাবালেঙ্কা। ফলে এর পর পাওয়ার গেম খেলতে গেলে তাঁর সমস্যা হবে। সেটাই হল। শটের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকল না। টেনিস সার্কিটে সাবালেঙ্কার থেকে ‘মুডি’ খেলোয়াড় খুব বেশি নেই। তিনি কখন কেমন খেলবেন তা তিনি নিজেও জানেন না। এই এক সেটে প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিচ্ছেন, তো পরের সেটে নিজেই উড়ে যাচ্ছেন। গফ সাবালেঙ্কাকে আরও বেশি রাগিয়ে দিলেন। তাতে তাঁর খেলা আরও খারাপ হল। দ্বিতীয় সেটে দাঁড়াতেই পারলেন না সাবালেঙ্কা। তৃতীয় সেটে কিছুটা লড়াই করেছিলেন বটে। কিন্তু তত ক্ষণে খেলা থেকে তাঁর মন উঠে গিয়েছে। গফ জানতেন, এই সাবালেঙ্কাকে তাঁকে হারাতে হবে না। সাবালেঙ্কা নিজেই হেরে যাবেন। সেটাই হল। প্রথম বার ফরাসি ওপেন জেতা হল না বেলারুসের খেলোয়াড়ের। সাবালেঙ্কার ব্যাক হ্যান্ড লাইনের বাইরে পড়তেই লাল সুরিকর কোর্টে শুয়ে পড়লেন গফ। মাত্র ২১ বছর বয়সে দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতলেন তিনি। তার পর গ্যালারিতে দৌড়়ে গেলেন গফ। পরিবার, তাঁর কোচ ও দলের বাকিদের সঙ্গে উৎসবে মাতলেন। অন্য দিকে সাবালেঙ্কা তখন হতাশ হয়ে চেয়ারে বসে। হারের হতাশায় চোখের জল বাঁধ মানল না। রানার্সের ট্রফি নিতে গিয়ে কেঁদে ভাসালেন সাবালেঙ্কা। রানার্সের ট্রফি হাতে সাবালেঙ্কা স্বীকার করে নিয়েছেন যে গফ তাঁর থেকে ভাল খেলোয়াড়। বলেন, “এই রকম কঠিন পরিবেশে গত দু’সপ্তাহ ভাল টেনিস খেলার পর এই হার খুব যন্ত্রণার। তবে গফকে অভিনন্দন। তুমি আমার থেকে ভাল খেলোয়াড়। তুমি লড়াই ছাড়োনি। ভাল খেলেছ। আমাকে ভুল করতে বাধ্য করেছ। দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যামের জন্য তোমাকে শুভেচ্ছা।” তখনও কেঁদে চলেছেন সাবালেঙ্কা। কারণ জানেন, সুযোগ নষ্ট করেছেন। শিয়নটেককে সেমিফাইনালে হারানোর চ্যাম্পিয়ন নিশ্চিত ছিল। তবু হল না!

টেনিস ছাড়ার ইঙ্গিত দিলেন নোভাক জোকোভিচ। ইয়ানিক সিনারের বিরুদ্ধে হার। ফরাসি ওপেনের সেমিফাইনালে স্ট্রেট সেটে হেরে বিদায় নিলেন ২৪টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক। কদাচিৎ লাল সুরকির কোর্টে ফিরবেন কি না জানেন না জোকোভিচ। ৩ ঘণ্টা ১৬ মিনিটের লড়াইশেষে হার মানেন জোকোভিচ। বিশ্বের এক নম্বর সিনারের বিরুদ্ধে হেরে এ বারের ফরাসি ওপেন থেকে বিদায়। ম্যাচ শেষে জোকোভিচ দর্শকদের উদ্দেশে হাত নাড়ার ভঙ্গিমাতেই স্পষ্ট বিদায়ের ইঙ্গিত। পরে জোকোভিচ সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, “এখানে আমার খেলা শেষ ম্যাচ হয়তো এটা। জানি না আমি আর এখানে খেলতে আসতে পারব কি না। সেই কারণেই ম্যাচশেষে আবেগ গ্রাস করেছিল। যদি রোলঁ গারজেঁ এটাই আমার শেষ ম্যাচ হয়ে থাকে, তা হলে সেটা খুবই ভাল একটা ম্যাচ ছিল। সমর্থকদের যে ভালবাসা পেয়েছি, তা অসাধারণ। আমি কি আরও খেলতে চাই? হ্যাঁ, আমি চাই। কিন্তু এক বছরের মধ্যে আমি আবার এখানে ফিরতে পারব? জানি না। এই মুহূর্তে এইটুকুই বলতে পারব।” ২০২৩ সালে ইউএস ওপেন জিতেছিলেন জোকোভিচ। তার পর থেকে আর কোনও গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে পারেননি তিনি। গত বছর উইম্বলডনের ফাইনালে উঠলেও কার্লোস আলকারাজের বিরুদ্ধে হেরে যান। পরে প্যারিস অলিম্পিক্সে তাঁকে হারিয়েই সোনা জিতেছিলেন জোকোভিচ। সেই ম্যাচটি ফিলিপ শঁতিয়ে কোর্টেই হয়েছিল। যে কোর্টে সিনারের বিরুদ্ধে হেরে গেলেন। ফাইনালে ওঠেন আলকারাজও। হারিয়ে দেন লোরেঞ্জো মুসেত্তিকে। ম্যাচের আগে আলকারাজ সম্মান জানালেন রাফায়েল নাদালকে। স্পেনের টেনিস তারকা ১৪ বার ফরাসি ওপেন জিতেছিলেন। ফিলিপ শঁতিয়ে কোর্টে তাঁর পায়ের ছাপ রেখে সম্মান জানিয়েছিলেন ফরাসি ওপেন কর্তৃপক্ষ। সেই পায়ের ছাপের ছবি তুলে রাখেন আলকারাজ। মুসেত্তির বিরুদ্ধে যদিও বেশ চাপে পড়ে গিয়েছিলেন প্রথম দিকে। পরে মুসেত্তি ম্যাচ ছেড়ে দেওয়ায় ফাইনালে ওঠেন আলকারাজ। রবিবার সিনারের বিরুদ্ধে খেলবেন।