‘আমার বন্ধু। বাংলা বিধানসভায় যিনি উঠে দাঁড়াতেই দিদি ভয় পেয়ে যান, এমন আমাদের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীজি।’ শুভেন্দুকে অধিকারী বড় সার্টিফিকেট দিলেন অমিত শাহ। বাংলা বিধানসভায় যিনি উঠে দাঁড়াতেই দিদি ভয় পেয়ে যান, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে এভাবেই সম্মোধন করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। শাহের এক বাক্যেই বিজেপির অন্দরে ও অন্যান্য দলেও আগামী নির্বাচনের সমীকরণ তৈরির কাজ অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে বলে ধারনা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে বিজেপির বিজয় সংকল্প সভায় বক্তব্যের শুরুতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমজারকে সম্মোধন করেন। এর পরই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে বিস্ফোরক সম্মোধনে উৎসাহে উচ্চস্বর স্টেডিয়ামে থাকা কয়েক হাজার বিজেপি নেতাকর্মীর। রাজ্য বিজেপিতে এখনও নতুন রাজ্য সভাপতির নাম ঘোষণা হয়নি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে প্রায় ১ বছর ধরে জেলা সভাপতির পদে রয়েছেন সুকান্ত মজুমদার। যা দলের নীতির পরিপন্থী। সুকান্ত মজুমদারের সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীর সখ্য কারও অজানা নয়। তাই অমিত শাহের এদিনের মন্তব্যের পর ভোটের আগে রাজ্য সভাপতি বদলের জল্পনায় পূর্ণছেদ পড়ল বলে মনে করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থীতালিকা চূড়ান্ত করা থেকে সংগঠনের দায়িত্ব থাকবে সুকান্ত– শুভেন্দু জুটির ওপরেই। অমিত শাহের কথায় স্পষ্ট।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ হচ্ছে। রবিবার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে বিজেপির বিজয় সংকল্প সভায় যোগদান করে এই মন্তব্য করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। তাঁর দাবি, রাজ্য সরকারের আমাদের সমস্ত জমি দিয়ে দিক, কথা দিচ্ছি সীমান্তে একটা ছুঁচোও গলতে পারবে না। কেন্দ্র বকেয়া মেটাচ্ছে না। এই অভিযোগে বারবার সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী মোদিকে চিঠিও লিখেছেন তিনি। রবিবার নেতাজি ইন্ডোরের সভা থেকে বকেয়া মেটানোর খতিয়ান তুলে ধরলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। দাবি করলেন, গত ১০ বছরে অর্থাৎ এনডিএ আমলে বাংলার জন্য ৮ লক্ষ ২৭ হাজার কোটি টাকা ছেড়েছে কেন্দ্র। শাহ বলেন, ‘বাংলার নির্বাচন শুধু বাংলার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে না, বাংলার নির্বাচন দেশের সুরক্ষার সঙ্গেও সম্পৃক্ত। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের দেশের সীমান্ত বাংলাদেশিদের জন্য খুলে রেখেছে। এনার আশীর্বাদে অনুপ্রবেশ হচ্ছে। অনুপ্রবেশ কি দিদি রুখতে পারবে? ভাইপো রুখতে পারবে? শুধুমাত্র পদ্মফুলের সরকার অনুপ্রবেশ রুখতে পারে। তৃণমূলের সাংসদ আমাকে সংসদে জিজ্ঞাসা করছিলেন বিএসএফ কী করছে? মমতা দিদি, আমরা আপনার কাছে জমি চেয়েছি। পুরো জমি দিয়ে দেও, বন্যা শেষ হতে দেও, একটা ছুঁচোও গলতে পারবে না। আপনি জেনে বুঝে সীমান্তে জমি দিচ্ছেন না। কারণ অনুপ্রবেশ হতে থাক, আপনার ভোটব্যঙ্ক বাড়তে থাকুক, আর আপনার পরে আপনার ভাইপো মুখ্যমন্ত্রী হোক। এটা হতে দেব না। বলে রাখি, রাজ্যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের বিবদ বেশ পুরনো। কেন্দ্রের দাবি, পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের মদতে অনুপ্রবেশ হয়। পালটা তৃণমূলের দাবি, কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিএসএফ সীমান্ত সুরক্ষার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। অনুপ্রবেশ হলে দায় তাদের। বলে রাখি, সম্প্রতি কোচবিহার সীমান্তে বিএসএফের হাতে এক বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী গ্রেফতার হয়। জানা যায়, ধৃত অনুপ্রবেশকারী মুর্শিদাবাদের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের দেওয়া ইমাম ভাতা পান তিনি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গ্রেফতার অধিকাংশ বাংলাদেশির অনুপ্রবেশকারীর কাছে পশ্চিমবঙ্গে তৈরি সরকারি পরিচয়পত্র পাওয়া গিয়েছে। রাজ্যের শাসকদলের সহযোগিতা ছাড়া যা সম্ভব নয়।’

আগামী ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সিঁদুরের মূল্য বোঝাবেন বাংলার মা-বোনেরা। অপারেশন সিঁদুরের পর রাজ্য সভা করতে আসায় নরেন্দ্র মোদীকে আক্রমণ করে পালটা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের আক্রমণের মুখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শাহ বলেন, ‘কিছুদিন আগে পহলগাঁওয়ে পাকিস্তানের পাঠানো সন্ত্রাসবাদীরা আমাদের নির্দোষ নাগরিকদের, পর্যটকদের ধর্ম জিজ্ঞাসা করে পরিবারের সামনে হত্যা করেছে। এই পাকিস্তানের পাঠানো সন্ত্রাসবাদীদের সাজা দেওয়া উচিত কি না? মোদীজি অপারেশন সিঁদুর করে ঠিক করেছেন কি করেননি? আমরা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছি, এয়ার স্ট্রাইক করেছি, আর এখন অপারেশন সিঁদুরে ১০০ কিমি ভিতরে গিয়ে ওদের হেড কোয়ার্টার ধ্বংস করে দিয়েছি। বহু সন্ত্রাসবাদী মারা গিয়েছে। আর দিদির পেটে ব্যথা হচ্ছে। বাংলার পর্যটকরা যখন ওখানে মারা গিয়েছিলেন তখন এই ব্যথা হলে ঠিক ছিল। তখন কিছু বলেননি। আর মোদীজি অপারেশন সিঁদুর করে এখানে এলে একটা নোংরা রাজনৈতিক মন্তব্য করে অপারেশন সিঁদুরের বিরোধিতা করেছেন। আমি মমতা দিদিকে বলতে এসেছি, আপনি অপারেশন সিঁদুরের বিরোধিতা করেননি, আপনি এই দেশের কোটি কোটি মা-বোনের ভাবাবেগের সঙ্গে ছেলেখেলা করেছেন। আমি বাংলার মাতৃশক্তিকে এই আবেদন করছি, আসন্ন নির্বাচনে অপারেশন সিঁদুরের ওপর প্রশ্ন তোলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সিঁদুরের মূল্য বাংলার মা-বোনেরা একটু বুঝিয়ে দেবেন। সিঁদুরের অপমান করার ফল কী হয়। ১৯৯০ থেকে এই দেশ সন্ত্রাসবাদ সহ্য করছে। ৪০ হাজারের বেশি মানুষ আতঙ্কবাদের শিকার হয়েছেন। এই কংগ্রেস – ইউপিএর সরকার, যেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যাও মন্ত্রী ছিলেন কিচ্ছু করত না। নরেন্দ্র মোদীর সরকার আসার পর গুলির জবাব গোলা দিয়ে দেওয়া শুরু হয়েছে। মমতাজি আপনি যত খুশি পাকিস্তানের পাঠানো সন্ত্রাসবাদীদের হয়ে গলা চড়ান না কেন, আমি বলে যাচ্ছি, এটা নরেন্দ্র মোদী সরকার। এটা বিজেপি সরকার। অপারেশন সিঁদুর শেষ হয়নি। এখন কেউ দুঃসাহস করবে, তাকে ততটাই জোরদার জবাব দেবেন নরেন্দ্র মোদীজি। আমি আজ আপারেশন সিঁদুরে আমাদের সাহসী সেনা ও বিএসএফ যে বীরত্ব দেখিয়েছ তাদের সবাইকে দুই হাত জুড়ে প্রণাম করছি। মুসলিম ভোটব্যাঙ্ককে খুশি করতে আপনি অপারেশন সিঁদুরের বিরোধিতা করেছেন।
এ রাজ্যে দেশভক্তদের সরকার হোক চায় গোটা দেশ। গোটা দেশ চায় পশ্চিমবঙ্গে দেশভক্তদের সরকার তৈরি হোক। আর সেজন্য অল্প দূরত্ব বাকি রয়েছে। ৪০ শতাংশ ভোট পাওয়ার লক্ষ্য পূরণ করে ফেলেছে বিজেপি। বাকি আর কয়েক শতাংশ। শাহ বলেন, ‘২০১৭র নির্বাচনের পরে আমরা প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম। ২০১৯ সালের লোকসভায় আমাদের সাফল্য মেলে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আমারা ৭৭টি আসন পেয়েছি। আর ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৯৭টি বিধানসভা আসনে বিজেপি এগিয়ে রয়েছে। ১৪৩টি আসনে ৪০ শতাংশের বেশি আমার কর্মীদের পরিশ্রমের জন্য ভোট পেয়েছি আমরা। আমি আজ নরেন্দ্র মোদীর সেনাদের বলতে চাই, আর অল্প দূরত্ব বাকি রয়েছে। ৪০ শতাংশ পার করে গিয়েছি, ৪–৫ শতাংশ পার করতে হবে। আগামী নির্বাচনে আমাদের সরকার তৈরি হবে। ২০১৭ সালে আমি দলের সভাপতি ছিলাম। তখন বলেছিলাম, এখানে আমাদের সরকার তৈরি হবে। আজ সেই দিন সন্নিকটে। ২০২৬ সালের নির্বাচন পর্যন্ত দিন রাত এক করে প্রত্যেক ভোটারের কাছে যান। নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপির বার্তা নিয়ে যান। গোটা দেশ চায় এখানেদেশভক্তদের সরকার তৈরি হোক। তোষণকারীদের সরকার যেন তৈরি না হয়।’
সংশোধিত ওয়াকফ আইন প্রত্যাহারের দাবি গত এপ্রিলে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বাংলার মুর্শিদাবাদ। আঁচ পড়েছিল মালদহেও। নেতাজি ইন্ডোরের সভা থেকে সেই অশান্তির দায় রাজ্যের কাঁধেই চাপালেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। শাহের সভায় ‘ব্রাত্য’ দিলীপ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, “মালদহ-মুর্শিদাবাদে স্টেট স্পনসর্ড অশান্তি হয়েছে। মুর্শিদাবাদের হিংসার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রের তরফে বারবার রাজ্যকে বিএসএফ মোতায়েনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই পরামর্শ ফিরিয়ে দেয় রাজ্য। আমাদের এক কর্মকর্তা হাই কোর্টে গেলেন বলেই বিএসএফ এল। হিন্দুরা বাঁচল। আমার বলতে কোনও দ্বিধা নেই, যেভাবে বাংলার মন্ত্রীরা এই সাম্প্রদায়িক হিংসায় যুক্ত ছিলেন, এর দায় রাজ্যের। বিজেপি কী করতে পারে, তার স্পষ্ট ধারণা আমাদের আছে। আর কীভাবে দাঙ্গা হয়, ওরাই সব থেকে ভালো জানে।”