রোহিত শর্মার টেস্ট ফরম্যাট থেকে অবসর জানান, অনেক হয়েছে। আর নয়। টেস্ট আর তিনি খেলবেন না। তবে ওয়ানডে খেলবেন। ভারতীয় টেস্ট দলের নেতৃত্ব থেকে রোহিত শর্মাকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন নির্বাচকরা। সর্বভারতীয় স্তরের এক সংবাদমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই হিটম্যান নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়ে দিলেন লাল বলের ফরম্যাট থেকে ব্যাট-প্যাড তুলে রাখছেন। ওয়ানডে ফরম্যাটে খেলতে দেখা যাবে। ইনস্টাগ্রামে রোহিত লেখেন, ”টেস্ট ক্রিকেট থেকে আমি অবসর নিচ্ছি। সাদা পোশাকে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সম্মান অর্জন করেছি। আপনাদের সবার ভালবাসা ও সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানাই। ওয়ানডে ফরম্যাটে আমি দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করব।” রোহিত অনেক আগেই নিজের ভাগ্যলিখন পড়ে বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর কথা নির্বাচকরা আর ভাবছেন না। ইংল্যান্ড সফরে নতুন অধিনায়ক টিম ইন্ডিয়াকে নেতৃত্ব দেবেন, তা একপ্রকার স্থির করে ফেলা হয়েছিল।রোহিত নিজের টেস্ট কেরিয়ারকে থামিয়ে দিলেন। লাল বলের ফরম্যাটে রোহিতের ফর্ম নিয়ে চিন্তিত ছিলেন নির্বাচকরা। নিজেদের মধ্যে আলোচনায় স্থির করে ফেলেছিলেন রোহিতের পরিবর্তে তরুণ কোনও ক্রিকেটারের হাতে তুলে দেওয়া হবে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড। তৈরি করা হবে পরবর্তী ক্রিকেট চক্রের জন্য। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারতের সাফল্যের পরে রোহিত নিজেও ইংল্যান্ড সফরে নেতৃত্ব নিয়ে আশাবাদী ছিলেন। মাইকেল ক্লার্কের পডকাস্টে ইংল্যান্ড সফরে বুমরাহ, সামি, সিরাজদের নিয়ে তৈরি বোলিং আক্রমণকে নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। আইপিএলের মধ্যেই বড়সড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন রোহিত গুরুনাথ শর্মা।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেক ঘটেছিল রোহিতের ২০১৩ এ। ২০২৪-এ বর্ডার-গাভাসকর ট্রফিতে চতুর্থ টেস্টই রোহিতের শেষ ম্যাচ। ৬৭টি টেস্টে ৪,৩০১ রান তাঁর ঝুলিতে। ১২টি সেঞ্চুরির মালিক তিনি। ২৪টি টেস্টে তিনি দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জিতেছেন ১২টিতে। হার ৯টায়। ড্র তিনটিতে। জয়ের শতাংশ ৫০। ক্যারিবিয়ানদের বিরুদ্ধ অভিষেক টেস্টে ১৭৭ রান করেন রোহিত। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ২১২ রান করেন। টেস্টে রোহিতের ভবিষ্যৎ নিয়ে দীর্ঘ বৈঠকে নির্বাচকরা চিন্তাভাবনা করেন, ইংল্যান্ড সফরের জন্য নতুন একজন নেতা চান। নির্বাচকরা রোহিতকে ভাবছেন না নেতা হিসেবে। রোহিত শর্মা টেস্ট ফরম্যাট থেকে অবসর নেওয়ায় সাদা পোশাকের ফরম্যাটে জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে শুভমান গিল। ইংল্যান্ড সফরে টেস্টে গিলের হাতে উঠতে পারে নেতৃত্বের ব্যাটন। জাতীয় নির্বাচকরাও তাঁর দিকেই। ইংল্যান্ড সফরে নতুন অধিনায়ক টিম ইন্ডিয়াকে নেতৃত্ব দেবেন, তা একপ্রকার স্থির করে ফেলা হয়েছিল। রোহিত অবসর গ্রহণ করায় নেতৃত্বের ব্যাপারে গিলের সম্ভাবনা বাড়ল।
রোহিত বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর এই সিদ্ধান্ত ‘সহি হ্যায়’। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে ১৩ বছরের খরা ভারতের। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নক আউটে গিয়ে হারার যন্ত্রণা। ভারতের আইসিসি ট্রফি জয়ে ২০২৪ সালের ২৯ জুন আসমুদ্র হিমাচল আনন্দ করেছিল। আনন্দের কেন্দ্রে থাকা রোহিতই দেশবাসীর মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন। আইপিএলের মাঝেই টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে গেলেন। বিশ্বকাপ জেতার পরেই অবসর নিয়েছিলেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে। শুধু এক দিনের আন্তর্জাতিক। বিশ্বজয়ের পর সমালোচনায় বিদ্ধ হয়ে টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে গেলেন রোহিত গুরুনাথ শর্মা। ভারতের লাল বলের ক্রিকেটে শেষ হয়ে গেল ‘হিটম্যান’ অধ্যায়। বিদায় জানালেন মাথা নিচু করে। ২০২৩ সালে রোহিত ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বার্বাডোজে বিশ্বকাপ জিতে মাঠেই পুঁতে দিলেন জাতীয় পতাকা। পিচে গিয়ে মাটি খুঁটে খেলেন। যে পিচ তাঁকে এত সম্মান দিয়েছে, সেই পিচের স্বাদ নিতে চেয়েছিলেন রোহিত। চোখে জলের পাশপাশি মুখে ছিল সেই অমলীন হিটম্যানের হাসি। বিশ্বকাপ ট্রফি নেওয়ার সময়ও লিয়োনেল মেসির কায়দায় হাঁটলেন রোহিত। জানিয়ে দিলেন, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিচ্ছেন।
আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় ছোটতে বাবা-মার সঙ্গে থাকতেন না রোহিত। বাবা গুরুনাথ মরাঠি হলেও মা পুর্ণিমা অন্ধ্রপ্রদেশের মেয়ে। ডোম্বিভলিতে এক কামরার ঘরে থাকতেন। সেই কারণে, রোহিত থাকতেন বোরিভলিতে। ঠাকুর্দা, ঠাকুমা, কাকাদের সঙ্গে। সপ্তাহে এক বার বাবা-মার সঙ্গে দেখা হত। রোহিতের কাকা একটি ক্রিকেট ক্যাম্পে ভর্তি করে দেন। রোহিতের ছোটবেলার কোচ দীনেশ লাড তাঁর মধ্যে প্রতিভা দেখেছিলেন। ছোটতে রোহিত ছিলেন অফ স্পিনার, ব্যাটও করতে পারেন। ব্যাটার তৈরি করেন দীনেশ। মুম্বইয়ের বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ পাওয়ার পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রোহিতকে। রোহিত বলেছেন, “আপনি যতই প্রতিভাবান হোন না কেন, পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। প্রতিভা কোনও দিন পরিশ্রমকে হারাতে পারে না। কিন্তু পরিশ্রম প্রতিভাকে হারিয়ে দেয়।” পরিশ্রমই রোহিতকে জায়গা করে দিয়েছে ভারতীয় দলে। ২০০৭ সালে ভারতের জাতীয় দলে পথচলা শুরু রোহিতের। ভারতীয় ক্রিকেটে থাকা শচীন তেন্ডুলকর, বীরেন্দ্র সহবাগ, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ, জাহির খান, মহেন্দ্র সিংহ ধোনিদের সঙ্গে সাজঘরে থেকেছিলেন রোহিত। প্রথমে নামতেন মিডল অর্ডারে। ধীরে ধীরে ওপেনার হিসাবে জায়গা পাকা করেন। সহবাগের ছেড়ে যাওয়া জুতোয় পা গলান রোহিত। আক্রমণাত্মক ব্যাটিং। প্রতিপক্ষ বোলারদের নিয়ে ছেলেখেলা।
মুম্বইয়ের ক্রিকেটারদের মতো অলস ব্যাটিং করতেন। সুনীল গাভাসকার বলেছিলেন, “রোহিতকে দেখলে মনে হয়, কোনও তাড়াহুড়ো নেই ওর। আরাম করে শট খেলছে। কোমরের উপরে ওকে বল করলে সেই বল গ্যালারিতে গিয়ে পড়বেই। এটাই মুম্বই ক্রিকেটের ধারা। রোহিত তা বহন করছে।” রোহিতের পছন্দের শট পুল। মিড উইকেট থেকে ফাইন লেগ এলাকায় যে কত বল বাউন্ডারির বাইরে গিয়ে পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর খেলার ধরনের কারণেই ‘হিটম্যান’ নাম হয়ে গিয়েছিল রোহিতের। সাদা বলের ক্রিকেটে তাঁকে ভয় পেতে শুরু করেন বোলারেরা। ২০০৭ থেকে টেস্ট ও এক দিনের ক্রিকেট খেললেও লাল বলের ক্রিকেটে রোহিত সুযোগ পান অনেকটা পরে। সেই সময় দলে জায়গাও ছিল না। ২০১৩ সালে মিডল অর্ডারে জায়গা পান তিনি। আর প্রথম দর্শনেই বাজিমাত। ইডেনে প্রথম টেস্টে শতরান। ঘরের মাঠ ওয়াংখেড়েতে দ্বিতীয় টেস্টেও শতরান। ২০১৮-১৯ সালে ওপেন করা শুরু করেন রোহিত। লাল বলের ক্রিকেটেও দাপট। টেস্টে ৪,৩০১ রান, এক দিনের ক্রিকেটে ১১,১৬৮ রান ও টি-টোয়েন্টিতে ৪,২৩১ রান করেছেন রোহিত। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ১০৮টি অর্ধশতরান ও ৪৯টি শতরান করেছেন। তাঁর কৃতিত্বও কম নয়। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সর্বাধিক রানের মালিক। এক দিনের ক্রিকেটে তিনটি দ্বিশতরান রয়েছে, যা আর কারও নেই। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে একটি ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ২৬৪ রানও তাঁর দখলে। এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি পাঁচটি শতরান করেছেন রোহিত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মেরেছেন। আক্ষরিক অর্থেই হিটম্যান হয়ে উঠেছেন বোরিভলির গলিতে ঠাকুমার সেলাই করা ৪৫ নম্বর গেঞ্জি পরে খেলা ছেলেটা। পরে সেই ৪৫ নম্বর জার্সি পরেই মাঠ কাঁপিয়েছেন রোহিত।
ব্যাটার রোহিতকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন অধিনায়ক রোহিত। তাঁর নেতৃত্বের হাতেখড়ি মুম্বই ক্রিকেটে। অজিত আগরকর অবসর নেওয়ার পর রোহিতকে অধিনায়ক করা হয়। তার পরে আইপিএল। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন করেছেন। পরে সেই রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছেন ধোনি। বিরাট কোহলির পরে তাই রোহিত ছাড়া আর কারও কথা ভাবেননি নির্বাচকেরা। মাঠে বড় দাদার ভূমিকায় রোহিত ভুল করলে যেমন বকেন, ভাল খেললে পিঠ চাপড়ে দেন। ক্রিকেটারদের পাশে থাকতেন রোহিত। তাঁদের ভরসা দিতেন। মাঠে রোহিতের বিভিন্ন কথা ভাইরাল হয়ে যেত। যেমন, অমনোযোগী ফিল্ডারদের বলেছিলেন, “কী রে তোরা বাগানে ঘুরতে এসেছিস নাকি। বলের দিকে খেয়াল রাখ।” বা সিলি পয়েন্টে দাঁড়ানো বিনা হেলমেটের সরফরাজ় খানকে বলেছিলেন, “বেশি হিরো হওয়ার দরকার নেই। হেলমেট পরে আয়।”
ভারতের ক্রিকেট খেলার ধরন বদলে ফেলেছিলেন রোহিত। ধোনি বার বার বলেন একটি প্রসেস-এর কথা। সেখানে হার-জিতের থেকেও খেলার ধরন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রোহিতকে খেলাতে বাদ পড়তে হয়েছিল শুভমন গিলকে। ব্যাটিং অর্ডারে নামতে হয়েছিল লোকেশ রাহুলকে। রোহিত সাফল্য পাননি। দেওয়াল লিখন যেন দেখতে পাচ্ছিলেন রোহিত। সেই কারণে সাংবাদিক বৈঠকে নিজের খেলার সমালোচনা করছিলেন। খারাপ পারফরম্যান্সের প্রভাব পড়েছিল রোহিতের অধিনায়কত্বেও। রোহিত নন, গম্ভীরই দল চালাচ্ছেন। অনুশীলনেও দেখা গিয়েছিল, নিজের পরিচিত জায়গা স্লিপে ছিলেন না রোহিত। দলের সহ-অধিনায়ক জসপ্রীত বুমরাহের সঙ্গে দীর্ঘ ক্ষণ কথা বলতে দেখা গিয়েছিল অজিত আগরকর ও গম্ভীরকে। সিডনিতে বাদই পড়তে হয়েছিল রোহিতকে। ঠিক চার মাস পর টেস্ট শেষে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন ভারত অধিনায়ক। অবসর নিলেন টেস্ট থেকে। শেষ হয়ে গেল একটা যুগ। কোনও সাংবাদিক বৈঠক করেননি রোহিত। ইনস্টাগ্রামে চার লাইনের একটি বিবৃতি দিয়েছেন শুধু। সেখানে রোহিত লিখেছেন, “সকলকে জানাতে চাই যে, আমি টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিচ্ছি। সাদা পোশাকে দেশের হয়ে খেলা আমার কাছে গর্বের। এত বছর ধরে এত ভালবাসা ও সমর্থনের জন্য সকলকে ধন্যবাদ। এক দিনের ফরম্যাটে ভারতের হয়ে খেলা চালিয়ে যাব।” চার লাইনের বিবৃতিতেই শেষ করে দিলেন এক ‘হিটম্যান’ যুগ।