তড়িঘড়ি সঞ্জয় রায়ের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে হাই কোর্টে মুখ্যমন্ত্রী!প্রশাসক মমতাকে ‘বিড়ম্বিত’ করার কারণে সিদ্ধান্ত ‘রাজনৈতিক’?

হাসপাতালের অভ্যন্তরে চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা। প্রশ্ন উঠেছিল কলকাতা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। আরজি কর মামলায় ধর্ষক-খুনি সঞ্জয় রায়ের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা রাজ্য সরকারের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যান উচ্চ আদালতে। মামলা দায়ের এবং গৃহীত হয়েছে। কিন্তু এত তড়িঘড়ি কেন? কারণ, মমতার সিদ্ধান্ত ‘রাজনৈতিক’। রাজনীতিক মমতা প্রশাসক হিসাবে ভেবেচিন্তেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আরজি কর-কাণ্ডে নজিরবিহীন নাগরিক আন্দোলন প্রশাসক মমতাকে ‘বিড়ম্বিত’ই করেছিল। তৃণমূলের সাড়ে ১৩ বছরের শাসনে মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রশাসক মমতাকে এই ধরনের আন্দোলনের মুখে পড়তে হয়নি। আন্দোলনে জুড়ে ছিলেন বিপুলসংখ্যক মহিলা। আন্দোলনে সরকার-বিরোধিতার জোরালো স্বর ছিল। তবে কী, আরজি কর দিয়েই আরজি করের ক্ষতে ‘প্রলেপ’ দেওয়ার পদক্ষেপ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই ‘দ্রুততা’ কেন? আরজি করের ধর্ষণ-খুনের মামলায় শাস্তি ঘোষণার অব্যবহিত পরেই তৃণমূলের তরফে সংগঠিত ভাবে একটি কথা বলা হতে থাকে। তা হল: সম্প্রতি জয়নগর, ফরাক্কা এবং গুড়াপে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় দোষীর ফাঁসির সাজা হয়েছে। সেই মামলাগুলির তদন্তভার ছিল রাজ্য পুলিশের হাতে। অর্থাৎ, রাজ্যপুলিশ ফাঁসির শাস্তি ‘আদায়’ করতে পেরেছে। সিবিআই পারেনি। একই কথা জানান মমতাও। সঞ্জয়ের ফাঁসি চেয়ে হাই কোর্টে যাওয়া সিবিআইয়ের উপর ‘চাপ’ তৈরিরও কৌশল। অধাকাংশের মতে মহিলা মননের প্রতি ‘সহমর্মিতা’ র ব্যাখ্যা। ষড়যন্ত্রের গন্ধ? ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার সঙ্গেই রয়েছে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের বিপুল দুর্নীতি। সেই তদন্ত এখনও চলছে। তার মধ্যেই সঞ্জয়ের ফাঁসির জন্য এত তৎপরতা কেন? এ-ও একটা বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ?
প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারের ‘পহেলা বাইশ’ ওয়ার্ডের তিন নম্বর সেলের আবাসিক সঞ্জয় রায়। সংশোধনাগারের অন্দরে খোলসের ভিতরে গুটিয়ে বলে মত কারারক্ষীদের। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার এবং সাজা ঘোষণার আগে-পরে জেলের অন্দরে সে ছিল নির্বিকার। জনৈক কারারক্ষী বলেন, “দুপুরে খাওয়ার সময়ে ওকে (সঞ্জয়) আমরাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমার ফাঁসির সাজা হতে পারে বলে শুনছি। ও উত্তরে বলে, আমি নির্দোষ। সেটা আমার থেকে ভালো কে আর জানে! আমার আইনজীবীরাই যা কিছু দেখবে। আমার কোনও প্রভাব-প্রতিপত্তি বা টাকা-পয়সা নেই। আমি আর কী করতে পারি।” সঞ্জয়ের আইনজীবী কবিতা সরকার বলেন,”নিম্ন আদালতের আমরণ কারাবাসের সাজার প্রেক্ষিতে আমরা হাইকোর্টে আবেদন করতে চলেছি।”
প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারের সেলে এত দিন বিচারাধীন বন্দি হিসেবেও নিঃসঙ্গ ভাবে সে থাকত। ‘হাই-প্রোফাইল’ বিচারাধীন বন্দির জন্য বিশেষ পাহারার ব্যবস্থা ছিল। সেলের ভিতরে সিসি ক্যামেরা ছিল। একদা কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় কার্যত গুটিয়ে নিয়েচে নিজেকে। সাজাপ্রাপ্ত বন্দি হিসেবে সঞ্জয়কে এখন দিনমজুরি করতে হবে। সঞ্জয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক। লেখালিখির কাজ সঞ্জয়কে দিয়ে হবে না। বাগানের কাজে তার মধ্যে কিছুটা আগ্রহের আভাস মিলেছে। সঞ্জয়ের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সংশোধনাগারের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিদিন কাজে ১১০ থেকে ১৩৫ টাকা মজুরি। সঞ্জয়ের কাজ অনুযায়ী মজুরি ঠিক হবে। জনৈক কারাকর্তা বলেন, “এখন সঞ্জয়ের জন্য একটি ‘নোটবুক চালু হবে। তাতে সঞ্জয়ের সব আচার-আচরণ নথিভুক্ত করা হবে।”
নিম্ন আদালতের রায়ের দুদিন পরই আর জি কর মামলা উঠছে সুপ্রিম কোর্টে। শীর্ষ আদালতে বুধবার প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার ডিভিশন বেঞ্চে মামলার শুনানি হবে। তালিকায় ৪২ নম্বরে রাখা হয়েছে আর জি কর মামলা। নিম্ন আদালতের রায়ে দোষী সঞ্জয় রায়ের আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজার পর প্রথমবার শীর্ষ আদালতে উঠবে আর জি কর মামলা। ডিসেম্বরের শেষের দিকে শেষবার আর জি কর ইস্যুতে শীর্ষ আদালতের দায়ের করা স্বতঃপ্রণোদিত মামলার শুনানি হয়েছিল। সেসময় আদালত জানায়, জুনের তৃতীয় সপ্তাহে মামলাটি ফের শোনা হবে। তবে এর মধ্যে কোনও পক্ষ যদি নতুন করে কোনও অভিযোগ জানাতে চায়, বা মামলা সংক্রান্ত নতুন কোনও তথ্য পেশ করতে চায় তাহলে সেই সুযোগ দেওয়া হবে। নির্যাতিতার বাবা-মা শীর্ষ আদালতে নতুন করে এই মামলা নিয়ে নিজেদের বক্তব্য জানানোর আর্জি জানিয়েছেন। সেই আর্জি মেনেই বুধবার মামলাটি শোনা হচ্ছে বলে খবর। আদালত কেন আর জি করের ঘটনাকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ অপরাধ হিসাবে গণ্য করল না তা নিয়ে শীর্ষ আদালতেও উঠতে পারে। নিম্ন আদালতের রায়ে অসন্তুষ্ট রাজ্য সরকারের কলকাতা হাই কোর্টে দায়ের করা মামলার পৃথক শুনানি হবে কলকাতা হাই কোর্টে।