February 11, 2025

লাগাতার যুদ্ধে পশ্চিম এশিয়ার এক সময়ের ‘সম্রাট’ আজ আহত! টাইগ্রিস নদীর তীরের দেশটি ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছে কালের গর্ভে।

0
Soudi Arabia

আজ আর নেই পশ্চিম এশিয়ায় শক্তির ভরকেন্দ্র। প্রাচুর্যের নিরিখে আত্মপ্রকাশ দুই আরব মুলুকের। প্রভাব আরও একটি রাষ্ট্রের। কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে পুরনো সাম্রাজ্য। গত শতাব্দীতেও সেখানকার সেনাশাসকের চোখরাঙানিতে চলতে হত ‘সুপার পাওয়ার’ আমেরিকাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল ইরাকের হাতে। বাগদাদের সামরিক ক্ষমতা ছিল দেশগুলির উপর। নতুন শতাব্দীতে বিশ্ব রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর দেশ। হামাস-ইজরায়েল যুদ্ধ হোক বা সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের ক্ষমতা দখল, ইতিহাসের মোড় ঘোরানো ঘটনাগুলির পর এক বারও শোনা যায়নি বাগদাদের নাম। বর্তমানে পশ্চিম এশিয়ার ভাগ্য নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় উঠে এসেছে তিনটি দেশ— সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং কাতার। তিনটি রাষ্ট্রের কোষাগারে অর্থের অভাব নেই। পাশাপাশি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, সমাজ সংস্কার বা রাজনৈতিক মধ্যস্থতায় প্রথম সারিতে তিন আরব মুলুক।গত শতাব্দীর আশি এবং নব্বইয়ের দশকে এই কাজটিই করত ইরাক। পশ্চিম এশিয়ার দেশটি সুপ্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার চারণভূমি হিসাবে পরিচিত।

ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, খ্রিস্টীয় নবম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী ছিল এর প্রকৃত স্বর্ণযুগে বাগদাদের তখ্‌তে ছিলেন আব্বাসীয় খলিফারা, যার অন্যতম হলেন হারুন অল-রশিদ। পঞ্চদশ শতাব্দীতে পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী শহর হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে বাগদাদ। ওই সময়ে সারা দুনিয়ার অন্যতম জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ছিল ইরাকের বর্তমান রাজধানী। পাশাপাশি বাণিজ্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি করেছিল টাইগ্রিস নদীর দেশটি। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি এবং মাথাপিছু গড় আয়ের নিরিখে বিশ্বের প্রায় সব দেশকেই ছাপিয়ে গিয়েছিল ইরাক। পরবর্তী কালে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার চারণভূমিতে জন্ম নেয় বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং ধর্মীয় কট্টরতা। দুর্বল হয়ে পড়ে সাম্রাজ্য। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য ১৫৩৪ সালে বাগদাদ দখল করেন অটোমান শাসকেরা। অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিশে যায় ইরাক। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের হাতে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হয় তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য। বাগদাদ তখন কব্জা করেছে ইংরেজ ফৌজ। ১৯২১ সালে মক্কার শরিফ হোসেনের ছেলে ফয়সলকে ইরাকের প্রথম রাজা হিসাবে নিযুক্ত করে ব্রিটেন। ব্রিটেনের টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিসের তীরে দানা বাঁধে বিদ্রোহ। ১৯৩২ সালে ব্রিটেনের কবলমুক্ত হয় ইরাক। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার চারণভূমিতে ফের পা পড়ে ব্রিটিশ ফৌজের। মারাত্মক আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে বাগদাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইরাকে লম্বা সময় ধরে চলেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ব্রিটেন অবশ্য সেখান থেকে চলে গিয়েছে। ১৯৬২ সালে বাগদাদের রাজতন্ত্রকে উৎখাত করেন ব্রিগেডিয়ার আবদুল করিম কাশিম। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক জটিলতা কাটিয়ে রক্তপাত দেখতে দেখতেই আধুনিকতার দিকে এগিয়েছে ইরাক।

বাগদাদের রাজনীতিতে আসেন সাদ্দাম হুসেন। ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট হন। কিছুটা স্থিতিশীল হয় ইরাকের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। ইতিহাসবিদরা তাঁকে একনায়ক বলেছেন। কুর্সিতে বসে অবশ্য সমস্ত বিরোধী কণ্ঠস্বর বন্ধ করেন সাদ্দাম ও বাথ পার্টির নেতারা। ক্ষমতালাভের এক বছরের মধ্যেই ১৯৮০ সালে প্রতিবেশী ইরানের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন সাদ্দাম। লড়াই চলে টানা আট বছর। মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইরাকের অর্থনীতি। পশ্চিম এশিয়ায় বাগদাদের প্রভাব বাড়লেও সাদ্দামের ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হতে না-হতেই কুয়েত আক্রমণ করে বসে। সালটা ১৯৯০। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খনিজ তেল সমৃদ্ধ দেশটির দখল নিয়ে ফেলে ইরাকি ফৌজ। সাদ্দামের এই সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব আমেরিকা মেনে নেয়নি। ১৯৯১ সালে কুয়েতকে মুক্ত করতে ওয়াশিংটন মিত্র বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। বাধ্য হয়ে কুয়েত থেকে ফৌজ সরিয়ে নেন সাদ্দাম। পরবর্তী সময়ে বাগদাদের বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির অভিযোগ আনে আমেরিকা। ২০০৩ সালে টাইগ্রিসের তীরে নতুন করে আক্রমণ শানায় যুক্তরাষ্ট্র। আর্থিক ভাবে পঙ্গু সাদ্দামের পক্ষে তা ঠেকানোর ক্ষমতা ছিল না। মাত্র ২০ দিনের মধ্যেই ইরাকের অধিকাংশ শহর কব্জা করে ফেলে ওয়াশিংটনের মিত্র বাহিনী। মাটির নীচের গুপ্ত বাঙ্কারে তাঁদের হাতে ধরা পড়েন স্বয়ং সাদ্দাম। বিচারে সাদ্দামের মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেয় আদালত। ২০০৬ সালে গণহত্যার অভিযোগে তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলায় ইরাকের নতুন সরকার। বাগদাদে একটি যুগের অবসান ঘটে। সাদ্দামের মৃত্যুর পর আর কখনওই সে ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার চারণভূমি।

ইরাকের পতনের পর পশ্চিম এশিয়ায় দ্রুত উত্থান ঘটে কাতারের। ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে আমেরিকা। দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় বসেছে তালিবান। মধ্যস্থতায় কাতারের বড় ভূমিকা থাকায় দেশটির রাজধানী দোহায় চুক্তি সারে তালিবান এবং ওয়াশিংটন। ২০২৩ সাল থেকে চলা হামাস-ইজরায়েল যুদ্ধেও মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বড় ভূমিকা নিয়েছে কাতার। ইরান মদতপুষ্ট হামাস যে সমস্ত আমেরিকান নাগরিককে অপহরণ করেছিল, তাঁদের এক এক করে ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করছে দোহা। ২০২২ সালে ফিফা বিশ্বকাপের আয়োজনও করে আরব মুলুকের এই দেশ। মহিলাদের অধিকার থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তি, একাধিক ক্ষেত্রে প্রগতিশীল পদক্ষেপ করছে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। সৌদির যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন মেয়েদের গাড়ি চালানোর অনুমতি পর্যন্ত দিয়েছেন। আরব দেশটিতে আয়োজিত হয়েছে ফ্যাশন শো। ভারতের আদলে আমিরশাহি প্রশাসন আবার চেষ্টা চালাচ্ছে আইআইটি ক্যাম্পাস খোলার। নয়াদিল্লির সাহায্য নেন। দুবাই এবং আবু ধাবিতে ক্রিকেটের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। পশ্চিম এশিয়ার ইসলামীয় দেশগুলির থেকে একে আলাদা করেছে। প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসাবে এই এলাকায় ফের চুপিসারে পা জমাতে শুরু করেছে তুরস্ক। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে গত ১০ বছরে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল ব্যাপক উন্নতি করেছে এককালের ইউরোপের ‘রুগ্ন মানুষ’। আঙ্কারার হাতিয়ার রফতানির পরিমাণ ১১ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অতীতের অটোমান সাম্রাজ্য ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনায় বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়েপ এর্দোগানের।

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may have missed