February 11, 2025

মহাতারকা হওয়ার পথ থেকে কক্ষচ্যুত তারকা!‌ বিস্মৃতির অতলে শচীনকে চ্যালেঞ্জে করা কাম্বলি?

0
Vinod Kumbli

বিনোদ গণপতি কাম্বলি। ছোটবেলার খাতায় লাগানো এক জলছবি। পুরনো পৃথিবীর অনেক কিছুর মতোই। হঠাৎই ফিরে এসেছেন জনমানসে। একসময় স্টাইলিশ ব্যাটিংয়ে যিনি মন কাড়তেন সকলের। খোদ ডন ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড স্পর্শ করে গড়েছিলেন অনন্য নজির। সেই সুপারস্টার আজ অতীতের ক্ষীণ ছায়া মাত্র। বিশ্বাসই হয় না টাকমাথা, একমুখ পাকা গোঁফদাড়ির প্রবীণ মানুষটি একই লোক! পুরনো দিনে বাইশ গজে কাম্বলির ‘ধুঁয়াধার বল্লেবাজি’। আচমকাই কাম্বলিকে দেখলে বিশ্বাসই হবে না। কাম্বলি বলতেই চলে আসে তাঁর বাল্যবন্ধু শচীন তেণ্ডুলকরের নাম। যাঁর ঝকঝকে শরীরী ভাষা দেখলে বোঝা দুষ্কর বয়স পেরিয়েছে পঞ্চাশ! অথচ সদ্য পঞ্চাশের কোঠায় প্রবেশ করা কাম্বলির বয়সের উপরে

বয়সের ভারের চেয়েও কাম্বলির অসুস্থতা অনেক বেশি ভারী। এই ক্রিকেটারই বিশ্বখ্যাত হয়ে পড়া বন্ধুটিকেও চ্যালেঞ্জে ফেলে দিয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে ২১ বছর ৫৪ দিন বয়সে পরপর দুটি টেস্টে হাঁকিয়েছেন ডবল সেঞ্চুরি। প্রথমে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২২৪। জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ২২৭। ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন যুগের মশাল যাঁর হাতে শচীন তেণ্ডুলকর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাত্র বছর তিনেক কাটিয়েই নিজেকে প্রমাণ করে দিয়েছেন। কপিল দেবের মতো তারকা তখনও অবসর নেননি। তবু মিস্টার ইন্ডিয়ান ক্রিকেট শচীনই। মহাতারকাকে কড়া চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসেছিলেন কাম্বলি। শচীনের ডবল সেঞ্চুরি পেতে তখনও অনেক সময় বাকি। টেস্টেই কেবল নয়, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটেও দ্বিশতরান তাঁর অধরা। ওয়ানডে সেঞ্চুরিও হয়নি। অনেকেই ভেবেছিলেন এই ছেলেটা শচীনকেও ছাপিয়ে যাবে।

১৯৮৮ সালের হ্যারিস শিল্ডের সেমিফাইনালে ৬৬৪ রানের জুটি গড়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিল সারদাশ্রম বিদ্যা মন্দিরের দুই কিশোর। তাদের একজন ৩২৬। অন্যজন ৩৪৯। বিশ্বরেকর্ডও কাম্বলির অবদানই বেশি ছিল। শেষপর্যন্ত শচীন বেশি আলো কেড়ে নেন। কারণ, হ্যারিস শিল্ডে শচীনের রান ছিল অপরাজিত ২১, ১২৫, অপরাজিত ২০৭, অপরাজিত ৩২৯ এবং অপরাজিত ৩৪৬। সব মিলিয়ে পাঁচ ইনিংসে ১০২৮ রান। গড়ও ১০২৮-ই। একবারই আউট হয়েছিলেন। বছরখানেকের মধ্যে ঘরোয়া ক্রিকেটে অসামান্য পারফরম্যান্সের পর পাকিস্তান সফরে গিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন ‘পোস্টার বয়’ হয়ে গিয়েছিলেন শচীন। কাম্বলির রনজি কেরিয়ার শুরু হয় ছক্কা হাঁকিয়ে! ওয়ানডে কেরিয়ার শুরু ১৯৯১ সালে। টেস্ট অভিষেক ১৯৯৩ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। জীবনের তৃতীয় টেস্টেই ব্যাট থেকে এসেছিল সেই ২২৪। পরের টেস্ট জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে, ২২৭। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে টেস্ট সিরিজে এল জোড়া শতরান ১২৫ ও ১২০। তিনটি ভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে পরপর তিনটি শতরান করার নজির আর কেউ ছুঁতে পারেনি আজও। ১৪ টেস্ট ইনিংসে হাজার রানও ভারতীয় হিসেবে রেকর্ড। ঝলমলে তরুণ কাম্বলি। বিখ্যাত বন্ধুকেও ছায়াচ্ছন্ন করা শুরু। এরপরই শুরু ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ প্রবাদটির মিথ্যে হতে থাকা। কেরিয়ার শুরুর পরও মাত্র ২৩ বছর বয়সেই জীবনের শেষ টেস্ট খেলে ফেলবেন কাম্বলি! ওয়ানডে কেরিয়ার ২০০০ সাল পর্যন্ত। দুটি বিশ্বকাপও খেলা কাম্বলির জৌলুস গায়েব। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যখন দর্শকের রোষে খেলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়েছিলেন কাম্বলি। এ দৃশ্য অনেকেরই মনে রয়েছে।

গুরু আচরেকরের সবচেয়ে খ্যাতিমান ছাত্রের দ্যুতিতে ঢাকা পড়েছেন কাম্বলি। এবার আসা যাক ২০২৪। শচীন ও কাম্বলির মুখোমুখি হওয়া। শরীরী ভাষায় এক আশ্চর্য শৈথিল্য ও অস্বাভাবিকতা। গান গাইবার সময় কণ্ঠস্বর কেঁপে যাচ্ছে অসুখের ভারে। কোর্টনি ওয়ালস ভারতে সিরিজ খেলতে এসে দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন শর্ট পিচ বলে কাম্বলির কী নিদারুণ দুর্বলতা রয়েছে! যে দুর্বলতা কাম্বলি আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। শেন ওয়ার্নের গালাগালি সহ্য করতে না পেরে এক ওভারে ২২ রান করা ক্রিকেটারের প্রতিভা তো নেহাত কম ছিল না। আসলে মাঠের বাইরে ডিস্কোর নৈশ জীবন এবং হইহুল্লোড়ের ভিতরে শরীরটার ক্ষতি শুরু হয়েছিল। নষ্ট হয়েছে ফিটনেস। ধ্বংস হয়েছে ফোকাসের নিবিড়তা। সারা জীবনে জড়িয়েছেন অজস্র আইনি ঝামেলায়। নিজেরই আবাসনে গুন্ডামি, মদ খেয়ে গাড়ি চালানো এমনকী পরিচারিকাকে নিগ্রহের অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছে। ২০২২ সালে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে গ্রেপ্তারও হতে হয়েছিল। বিয়ে টেকেনি। দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। ততদিনে তাঁর আর্থিক দুরবস্থার কথা সর্বজনবিদিত। ক্রিকেট তাঁকে দুহাত ভরে দিলেও জা ধরে রাখতে পারেননি। আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যাওয়া বালির মতো ঝরে গিয়েছে সাফল্যের সব অণু-পরমাণু!

কেরিয়ারের ১৭টি টেস্টে ৫৪.২ গড় কাম্বলির। শচীনের থেকেও বেশি! প্রথম ইনিংসে গড় ৬৯.১৩, দ্বিতীয় ইনিংসে ৯.৪! ফারাক ৫৯.৭৩-এর। ধারাবাহিকতার অধ:‌পতন। খ্যাতি গিলে ফেলেছিল কাম্বলিকে। নিজের প্রতিভার প্রাপ্তি কাম্বলি হজম করতে পারেননি। দারিদ্র দেখেছিলেন শৈশবে। বড় হয়ে স্বাচ্ছন্দ্য পেয়ে হয়তো ফোকাস নড়ে গিয়েছিল। আর তাই আজকের প্রজন্মের কাছে তিনি এক অসুস্থ বুড়োটে মানুষ মাত্র। লিজেন্ডদের লিগেও নাকি শচীন ফিটনেস নিয়ে ভাবিত থাকেন, বেশি রাত করে ঘুমোতে যান না। অন্যদিকে কাম্বলির হৃদযন্ত্র কাহিল হয়ে পড়েছে ক্রমশ। ফলে বারবার সংক্রমণ। জলের মতো বয়ে গিয়েছে হারানো পৃথিবী।

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may have missed