January 14, 2025

সংখ্যালঘু বিতর্কে দলকে বারবার ফাঁপরে ফেলছেন ববি! ‘‌মমতা ঘনিষ্ঠ’‌ ‌ফিরহাদ অতীতেও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য করেছেন

0
Mamata Boby

‘‌আল্লাহ ছাড়া কারও সামনে মাথানত নয়’‌। ‘‌সংখ্যাগুরু’‌ বিতর্কে এবার ফিরহাদের জবাব। বিতর্কিত মন্তব্য প্রসঙ্গে ফিরহাদ বলেন, ‘‌আমি পরোয়া করি না। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ ছাড়া কারও সামনে মাথানত করা যায় না। কর্মটাই হল আমার জীবন, আর সেটা করাচ্ছেন আল্লাহতালা। তিনি থাকতে আমার কোনও ক্ষতি হবে না। তবে এভাবে হিন্দু বন্ধুদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।’‌ ক’দিন আগেই কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের পুরমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‌আমরা (সংখ্যালঘুরা) একদিন সংখ্যাগুরুর থেকেও সংখ্যাগুরু হব।’‌ মন্তব্য নিয়ে সমালচোনা শুরু হয়েছিল। তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে এই মন্তব্যের থেকে দূরত্ব তৈরি করা হয়েছিল। নিজের সেই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সাফাই দিলেন ফিরহাদ। ওয়াকফ বিল প্রত্যাহারের দাবিতে আয়োজিত এক সভায় ফিরহাদ বললেন, ‘‌সব ধর্মকে হৃদয় দিয়ে সম্মান করি। কিন্তু আমার নিজের ধর্ম আমি ১০০ শতাংশ মানি।’‌ শাখ দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা ববির। ফিরহাদের কথায়, ‘‌পিছিয়ে পড়া মানুষের শিক্ষার অগ্রগতির কথা বলা যদি অন্যায় হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে আমি অন্যায় করেছি। সবাইকে শিক্ষিত হতে হবে।’‌ এদিকে বিতর্কিত মন্তব্য প্রসঙ্গে ফিরহাদ বলেন, ‘‌আমি পরোয়া করি না। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ ছাড়া কারও সামনে মাথানত করা যায় না। কর্মটাই হল আমার জীবন, আর সেটা করাচ্ছেন আল্লাহতালা। তিনি থাকতে আমার কোনও ক্ষতি হবে না। তবে এভাবে হিন্দু বন্ধুদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।’‌

এক অনুষ্ঠানে ফিরহাদ বলেছিলেন, ‘‌বাংলায় আমরা ৩৩ শতাংশ। কিন্তু ভারতে মাত্র ১৭ শতাংশ। তবে আমরা নিজেদের সংখ্যালঘু ভাবি না। আমরা ভাবি আল্লাহর রহমত যদি আমাদের উপর থাকে তাহলে আমরা একদিন সংখ্যাগুরুর থেকেও সংখ্যাগুরু হব। আল্লাহর এই নির্দেশ তথা ইচ্ছাকে আমাদের তাকত দিয়ে হাসিল করতে পারব। আমাদের সম্প্রদায়… অনেক জায়গায় আমি দেখি যে কিছু হলেই মোমবাতি মিছিল করে থাকে। উই ওয়ান্ট জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস। আমি বলি, মিছিল করে জাস্টিস হবে না। নিজের ক্ষমতা এমন করতে হবে যে আপনি নিজেই জাস্টিস দেওয়ার যোগ্য হবেন, জাস্টিস চাইবেন না। জাস্টিস দেবেন। আজও কলকাতা হাইকোর্ট থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট- হাতেগোনা কয়েকজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিচারপতি আছেন। কারণটা কী? কারণ এতদিন আমাদের সেটার যোগ্য করে তোলা হয়নি। যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে বিচার দিতে পারি। সমাজতন্ত্রের মানে এই নয় যে যিনি বড় জায়গায় আছেন, তাঁকে টেনে নামানো হবে। বরং সেই বড় জায়গায় পৌঁছাতে হবে নিজেকে।’‌

তৃণমূলের তরফ থেকেও এই মন্তব্যের নিন্দা। বাবার মন্তব্যের ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমেছিলেন ফিরহাদকন্যা প্রিয়দর্শিনী। ফিরহাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করার অভিযোগ। ফিরহাদ হাকিম কি এই প্রথম সংখ্যালঘু প্রসঙ্গে ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য করলেন? না। বরং তাঁর দলের অনেকে মনে করেন, তাঁর আগের মন্তব্য ছিল ‘উগ্র সাম্প্রদায়িক’। সেই মন্তব্যের কারণে কি তাঁর দল তাঁর আনুষ্ঠানিক ভাবে নিন্দা করেছিল? না। তা হলে এ বার কেন? কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদের (ববি) যে মন্তব্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তাকে ‘নস্যাৎ’ করে অনুষ্ঠানিক ভাবে তার নিন্দা করতে হয়েছে তৃণমূলকে। দলের প্রথম সারির নেতারা একান্ত আলোচনায় গোপন করছেন না যে, সর্বময় নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ওই মন্তব্যের কারণে ববির উপর ‘রুষ্ট’। কেন?

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নের ঘটনা নিয়ে এ পার বাংলায় উদ্বেগ। পোড়খাওয়া রাজনীতিক মমতা জানেন, পড়শি দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর যে অত্যাচারের বিবরণ প্রকাশ্যে আসছে, তার আঁচ কাঁটাতারের এ পারেও রয়েছে। ফিরহাদের বক্তৃতার নিন্দা করতে তৃণমূল এক প্রকার ‘বাধ্য’ হয়েছে। ফলে অতীতে পার পেয়ে গেলেও এ বার ফিরহাদের মন্তব্যে নীরব থাকতে পারেনি তৃণমূল। বস্তুত, ফুরফুরা শরিফের একটি অংশও মনে করছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতির কারণেই ফিরহাদের বক্তব্যের নিন্দা করতে তৃণমূল সময় নষ্ট করেনি।

গত জুলাই মাসে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ফিরহাদ যা বলেছিলেন, তার নির্যাস— যাঁরা ইসলাম নিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি, তাঁরা ‘দুর্ভাগা’। ফিরহাদই সংখ্যালঘুদের ‘সংখ্যাগুরু’ হয়ে ওঠার ডাক দিয়েছেন। বাংলাদেশের ঘটনার আবহে তাতে নড়েচড়ে বসতে হয়েছে এ পার বাংলার শাসকদলকে। ‘বেফাঁস’ মন্তব্য ফিরহাদও করেছেন। দল স্পষ্ট করে দিয়েছে, ফিরহাদের ওই বক্তব্য তারা ‘অনুমোদন’ করে না। যা থেকে স্পষ্ট যে, ফিরহাদের ‘অপব্যাখ্যা’ ব্যাখ্যায় দল সন্তুষ্ট নয়। রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূল ধৈর্য্য ধরে, ভারসাম্য রেখে, সংবেদনশীলতার সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে মন্তব্য করছে। ফিরহাদের সাম্প্রতিক মন্তব্য তৃণমূলের তাল কেটে দিয়েছে। কারণ, ফিরহাদ শুধু দলের প্রথামসারির নেতা নন। রাজ্যের মন্ত্রীও বটে। তা ছা়ড়া, তিনি যে কলকাতার মেয়র, সেই শহরেও গত কয়েক বছরে একাধিক ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, উপরে উপরে সম্প্রীতির সুর বাজলেও ভিতরে কোথাও কোথাও বিদ্বেষের বীজ রোপিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফিরহাদের বক্তব্য তৃণমূলের কাছে তাই সব দিক থেকেই ‘বিড়ম্বনার’। ফিরহাদ কেন একাধিক বার এমন ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য করছেন। কারণ দু’টি। প্রথমত, প্রাক্তন রেলমন্ত্রী তথা দীর্ঘদিনের কংগ্রেস নেতা বরকত গনিখান চৌধুরীর মৃত্যুর পরে বাংলায় এমন কোনও সংখ্যালঘু নেতা উঠে আসেননি, যাঁর সারা রাজ্যেই ‘মুসলিম নেতা’ হিসাবে পরিচিতি রয়েছে। রাজ্যে আরও সংখ্যালঘু নেতা থাকলেও তাঁরা বিশেষ বিশেষ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকার নেতা। গত সাড়ে ১৩ বছরের তৃণমূল শাসনে সংখ্যালঘুদের ভোট শাসকদলের দিকে থাকলেও ফিরহাদ ছাড়া এমন কোনও সংখ্যালঘু নেতা উঠে আসেননি যাঁর কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত ‘দাপট’ রয়েছে। তৃণমূলের অন্দরে ‘ওজনদার’ নেতা তো বটেই, ফিরহাদ দাপুটে মন্ত্রীও। কিন্তু পাশাপাশিই ফিরহাদ কতটা পুরোপুরি ‘সংখ্যালঘুদের নেতা’ হয়ে উঠতে পেরেছেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, তিনি মহা ধুমধামে দুর্গাপুজোও করেন। অনেকের বক্তব্য, সেই কারণেই ফিরহাদ এই ধরনের মন্তব্য করে নিজেকে সংখ্যালঘুদের অবিসংবাদী নেতা করে তুলতে চাইছেন। দ্বিতীয়ত, তৃণমূলের অন্দরে অধুনা কিছু সংখ্যালঘু ‘মুখ’ গুরুত্ব পাওয়ায় ফিরহাদ ঈষৎ ‘সঙ্কটাপন্ন’। সেই মনোভাব থেকেও এই মন্তব্য। নানাবিধ কারণে দলের অন্দরে সংখ্যালঘু নেতা হিসাবে ফিরহাদের ‘একক দাপট’ খানিকটা হলেও খর্ব হচ্ছে। সেই কারণেই ফিরহাদ সংখ্যালঘু প্রশ্নে ‘অতি সক্রিয়’ হয়ে থাকতে পারেন। তৃণমূলের অন্দরে বলা হয়, মমতার দুই ‘ছায়া’ ববি (ফিরহাদ) এবং অরূপ বিশ্বাস। সেই ফিরহাদের মন্তব্য প্রসঙ্গে নিন্দা করে দলের বিবৃতি এবং মমতার রুষ্ট হওয়ার ঘটনা সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সমীকরণের প্রেক্ষাপটেও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may have missed