January 14, 2025

‘মানুষ জবাইয়ের কসাইখানা’ বাশারের! প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের কারণ

0
Seria

সিরিয়ার কুখ্যাত সেদনায়া কারাগার। যাঁরা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন, তাঁরা জানিয়েছেন, শুধুমাত্র মানসিক বা শরীরিক নির্যাতন করেই রেহাই দিত না কারাগারের ‘কসাই’রা। সমানে চলত যৌন অত্যাচার। নারী, পুরুষ থেকে নাবালক, নাবালিকা – রেহাই পেত না কেউ! প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ও তাঁর সরকারের পতন হতেই আবারও সংবাদ শিরোনামে সিরিয়ার কুখ্যাত সেদনায়া কারাগার। ‘মানুষ জবাইয়ের কসাইখানা’ বলে উল্লেখ!

কারাগারের এমন নামকরণের নেপথ্যে রয়েছে বন্দিদের উপর পৈশাচিক অত্যাচারের এক দীর্ঘ ইতিহাস! বাশার পরাস্ত হওয়ার পর ইতিমধ্যেই সেই ‘কসাইখানা’র অভ্যন্তরে বিদ্রোহীরা ঢুকে পড়েছে। তাদের ভিডিয়ো ক্যামেরায় বন্দি হয়ে প্রকাশ্যে এসেছে সেদনায়া কারাগারের অন্দরমহলের দৃশ্য। বাশার আল-আসাদের জমানায় হাজার-হাজার নারী, পুরুষ এমনকী শিশুকেও এই কারাগারে ধরে এনে বন্দি করে রাখা হত! তারপর সেই বন্দিদের উপর চলত অকথ্য অত্যাচার। দামাস্কাসে বিদ্রোহীরা ঢুকে পড়ার পরই আমজনতা সেই কসাইখানার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই বন্দিশালার সমস্ত কক্ষের দরজা ভেঙে ফেলে।

ইট, পাথর – যে যা দিয়ে পারছেন, তার সাহায্যেই কারাগারের একের পর এক কুঠুরির দরজা ভাঙছেন। ভিতর থেকে কাতারে কাতারে বেরিয়ে আসছেন বন্দিরা। সেই দলে নারী, পুরুষ ও একাধিক নাবালককেও ঘটনাস্থলে দেখা গিয়েছে। কারাগারের লৌহকপাট ভাঙতে বিদ্রোহীরা বন্দুকের গুলি ছুড়ে দরজার তালা খেলে। এই ঘটনার ফলে বহু বছর পর আপনজনদের কাছে ফিরতে ফেরেছেন বন্দিরা। তাঁদের পেয়ে আবেগে ভেসেছেন পরিবারের অন্য সদস্যরাও। সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাস থেকে এই কসাইখানার দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার।

বাশার আল-আসাদ ও তাঁর পরিবার যাতে গোটা সিরিয়ার উপর আজীবন রাজত্ব করে যেতে পারে, তা নিশ্চিত করতেই এই সেদনায়া কারাগারকে ব্যবহার করা হত। সরকারের বিরুদ্ধে ন্যূনতম বিরোধিতা দেখালেই সেই ব্যক্তিকে ধরে এনে এখানে বছরের পর বছর আটকে রাখা হত। শুধুমাত্র মানসিক বা শরীরিক নির্যাতন করেই রেহাই দিত না কারাগারের ‘কসাই’রা। সমানে চলত যৌন অত্যাচার। নারী, পুরুষ থেকে নাবালক, নাবালিকা – রেহাই পেত না কেউ! এই কারাগারের তিনটি তল রয়েছে মাটির নীচে। যাকে বলা হয় রেড প্রিজন বা লাল কারাগার। এখনও পর্যন্ত কারাগারের সেই অংশ খোলা সম্ভব হয়নি। কারাগারের ওই অংশটি বন্ধ রাখতে এমন জটিল তালা ব্যবহার করা হয়েছে, যা এখনও পর্যন্ত খোলা সম্ভবই হয়নি! আর, যে জেলকর্মীরা এতদিন ওই তালা খুলত, তারাও সবাই পালিয়ে গিয়েছে।

বাশার আল আসাদের ২৪ বছরের ‘সাম্রাজ্য’-এর পতন। সিরিয়া ছেড়ে বিদ্রোহের মুখে পালিয়ে গিয়েছেন। রাজধানী দামাস্কাস দখল বিদ্রোহীদের। বাশারকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে রাশিয়া। দেশ ছেড়ে সপরিবার সেখানেই আছেন। ২০০০ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসেছিলেন বাশার। তাঁর বাবা দীর্ঘ দিন ওই কুর্সিতে ছিলেন। ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় বাশার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু। শুরু হয় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। প্রথম থেকেই এই যুদ্ধে বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিল আমেরিকা। সিরিয়া সরকার রাশিয়া এবং ইরানের সহায়তা পেয়েছিল। ১৩ বছর ধরে কড়া হাতে যাবতীয় বিদ্রোহ দমন করেছে বাশারের প্রশাসন। পতনের সূচনা ২৭ নভেম্বর। ১২ দিনে সরকার পতনের পরিস্থিতি তাঁকে দেশ ছাড়তেও বাধ্য করেছে। বিদ্রোহীরা ১৩ বছরের চেষ্টায় যা করতে পারেননি, হঠাৎ ১২ দিনে তা করে দেখালেন?

পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ। সিরিয়া সরকারের অন্যতম দুই সমর্থকই যুদ্ধে ব্যস্ত। রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। ইরান ব্যস্ত পশ্চিম এশিয়ায় ইজরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষে। সিরিয়ার সরকার ফেলার জন্য এই সময়টিকেই উপযুক্ত বলে মনে করেছিলেন বিদ্রোহীরা। বিদ্রোহী দুই সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’ (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী ‘জইশ আল-ইজ্জা’র যৌথবাহিনীর আগ্রাসনের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়ে সিরিয়ার সরকার। মিত্র দেশগুলির কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য পাননি বাশার। ফলে বিদ্রোহীদের আগ্রাসনের মুখে কোনও প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেননি। ২৭ নভেম্বর, উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলিতে হামলা চালায় বিদ্রোহী গোষ্ঠী। উত্তর-পশ্চিম আলেপ্পো প্রদেশের ১৫টির বেশি গ্রাম তারা সরকারের দখলমুক্ত করার অভিযানের নেপথ্যে মূলত এইচটিএস। সরকারের তরফে পাল্টা প্রতিরোধ গড়তে বিদ্রোহীদের উপর আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ করে সিরিয়া সরকার এবং সহযোগীরা।

২৮ নভেম্বর, সরকারের প্রতিরোধে লাভ হয়নি। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আরও এগোতে শুরু করেন বিদ্রোহীরা। সীমান্তলাগোয়া ইদলিব প্রদেশে তাঁরা ঢুকে পড়েন। সরকারের বাহিনী পিছু হটে। ২৯ নভেম্বর, সিরিয়ার বৃহত্তম শহর আলেপ্পোতে ঢুকে পড়ে বিদ্রোহী বাহিনী। ২০১৬ সালে এই শহর থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। রাশিয়া এবং ইরানের সহায়তায় সিরিয়া সরকার আলেপ্পোয় সামরিক অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহীদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ২৯ তারিখে আবার সেই শহরে প্রবেশ করেন। ৩০ নভেম্বর, বিদ্রোহীরা ঘোষণা করেন, আলেপ্পো তাঁদের দখলে। শহরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও তাঁরা দখল করে নেন। শহরের প্রাণকেন্দ্রে পুঁতে দেন নিজেদের পতাকা। মধ্য সিরিয়ার হামা প্রদেশের অন্তত চারটি শহর ওই দিন সন্ধ্যার মধ্যেই বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়। প্রাদেশিক রাজধানীতেও প্রবেশ।

১ ডিসেম্বর, পাল্টা আঘাত হানে সিরিয়া সরকার। দেশের সেনাবাহিনী ইদলিব এবং আলেপ্পোতে আকাশপথে হামলা চালায়। সড়কপথেও সিরিয়ার সেনা বিদ্রোহীদের মুখোমুখি। দামাস্কাসে যান ইরানের বিদেশমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। প্রেসিডেন্ট বাশারকে আশ্বাস দেন, তেহরান পাশে আছে। ২ ডিসেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর, এক দিকে বাধা পেয়ে অন্য দিকে অগ্রসর হয় বিদ্রোহী বাহিনী। দক্ষিণে এগিয়ে হামা শহরের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ঢুকে পড়ে। হামা সিরিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। রাজধানী দামাস্কাস থেকে হামার দূরত্ব মাত্র ২০০ কিলোমিটার। বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য বাশারকে অনুরোধ করে তুরস্ক। ৫ ডিসেম্বর, হামা শহরে ঢুকে পড়েন বিদ্রোহীরা। এই শহরের আসি স্কোয়্যার এলাকা ২০১১ সালের বিদ্রোহের ‘আঁতুড়ঘর’ ছিল। ২০২৪-এ এসে আবার সেখানে আধিপত্য কায়েম করে বিদ্রোহী বাহিনী। আনন্দে শূন্যে গুলি ছুড়তে দেখা যায়।

৬ ডিসেম্বর, আরও এগিয়ে সিরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর হোমসে ঢুকে পড়ে বিদ্রোহীরা। এই শহরকে রাজধানীর প্রবেশপথ বলা চলে। সেই সঙ্গে এই হোমসেই রয়েছে সিরিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত দু’টি তৈল শোধনাগার। ফলে শহরটির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। হোমস থেকে সরকারের বাহিনী পিছু হটেছে— এই তথ্য অস্বীকার করে বাশারের প্রশাসন। সিরিয়া নিয়ে কাতারের রাজধানী দোহায় উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেন সৌদি আরব, মিশর, তুরস্ক, ইরান এবং রাশিয়ার প্রতিনিধি। ৭ ডিসেম্বর, হোমস থেকে সরকারের সমস্ত বাহিনী সরে যায়। শহরটি পুরোপুরি বিদ্রোহীদের দখলের পর ঘোষণা দামাস্কাস ঘিরে ফেলেছেন। অভিযানের শেষ এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে। ৮ ডিসেম্বর: সিরিয়ার সরকারি সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়, বাশারের সরকার পড়ে গিয়েছে। বন্দিদের মুক্ত করা হয়েছে। বিদ্রোহী নেতা গোলানি দামাস্কাসের মসজিদে যান এবং জয় ঘোষণা করেন। রাশিয়া এবং ইরানের সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়, বাশার সিরিয়া ছেড়ে রাশিয়ায় চলে গিয়েছেন। তাঁর পরিবারও সেখানেই রয়েছে। রাশিয়া তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে। সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ গাজি জালালি সুর নরম করে জানান, সিরিয়া সরকার বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাত মেলাতে এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করতে প্রস্তুত।

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may have missed