‘ফাঁসির সাজা’ রায়দান নিম্ন আদালতের! জয়নগরে নাবালিকা ধর্ষণ-খুনের মামলার ‘বিচারে’ সন্তুষ্ট মুখ্যমন্ত্রী!
আরজি কর-কাণ্ডের বিচারপ্রক্রিয়া এখনও চলছে। ওই মামলার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট। গত মাসে মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে শিয়ালদহ আদালতে। তা সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। অন্য দিকে, মাত্র ৬৩ দিনের মাথায় বিচার পেল জয়নগরের নির্যাতিতা।অন্যদিকে, জয়নগরে নাবালিকাকে ধর্ষণ-খুনের মামলায় শুক্র বিকেলে রায় ঘোষণা করে বারুইপুর আদালত। দোষীকে ফাঁসির সাজা শুনিয়েছেন বিচারক। সেই রায় ঘোষণার অনতিবিলম্বেই এক্স হ্যান্ডলে ‘ব্রেকিং নিউজ’ লিখে একটি পোস্ট করা হয় রাজ্য পুলিশের তরফে। সেখানে লেখা হল, ‘জাস্টিস ফর জয়নগর’ও! আধ ঘণ্টার মধ্যে এক্স হ্যান্ডলে একই বিষয়ে পোস্ট করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। আরজি করের আন্দোলনের আবহে গত ৪ অক্টোবর প্রকাশ্যে আসে জয়নগরের নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা। আরজি করের মতো জয়নগরকাণ্ড নিয়ে বিস্তর শোরগোল পড়েছিল রাজ্যে। জয়নগরে নির্যাতিতার বাড়িতে গিয়েছিলেন আরজি করের আন্দোলনকারীরাও।‘জাস্টিস ফর আরজি কর’-এর পাশাপাশি ‘জাস্টিস ফর জয়নগর’ স্লোগানও উঠেছিল অনশনমঞ্চে।ঘটনার দু’মাসের মধ্যে বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হয়ে দোষীর ফাঁসির সাজা হওয়ায় পুলিশকে অভিনন্দন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নিজেদের কাজেও ‘সন্তোষ’ প্রকাশ করেছে রাজ্য পুলিশ। এক্স হ্যান্ডলের পোস্টে তারা লিখেছে, ‘‘মেয়েটি আর ফিরবে না। কিন্তু যে অভূতপূর্ব দ্রুততায় তাকে এবং তার পরিবারকে আমরা ‘জাস্টিস’ দিতে পেরেছি, দীর্ঘ দিন বিচারহীন থাকতে হয়নি, এটুকুই আমাদের সান্ত্বনা, আমাদের প্রাপ্তি।’’
আরজি করের ঘটনার প্রায় দু’মাস পরে জয়নগরের ঘটনা ঘটেছিল। তদন্ত করেছিল রাজ্য পুলিশ। আরজি করের আগে সেই মামলায় ‘বিচার’ মেলায় স্বাভাবিক ভাবেই ‘খুশি’ পুলিশ মহল। আরজি কর-কাণ্ডে যে ভাবে কলকাতা পুলিশের উপর ‘অনাস্থা’ দেখিয়ে তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, তাতে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নের মুখে পড়েছিল পুলিশ-প্রশাসনের উপর ‘আস্থা-ভরসা’। আশ্চর্য নয় যে, জয়নগরকাণ্ডের বিচারের পর পুলিশের বক্তব্যে ‘খোঁচা’ও থাকবে! রয়েওছে। রাজ্য পুলিশের পোস্টে ‘দীর্ঘ দিন বিচারহীন থাকতে হয়নি’ মন্তব্যে সিবিআই তদন্ত নিয়ে খোঁচা দেওয়া হয়েছে বলেই মনে করছেন অনেকে।
৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে বাড়ি ফেরার পথে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল ওই নাবালিকা। মেয়ে বাড়ি না-ফেরায় খোঁজাখুঁজি শুরু করেন পরিবারের লোকজন। স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে যাওয়া হয় প্রথমে। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগও ওঠে। এর পর গভীর রাতে বাড়ির কাছের জলাজমি থেকে মেলে মেয়েটির দেহ। ওই রাতেই গ্রেফতার হয় মোস্তাকিন সর্দার নামের এক ব্যক্তি। পরের দিন সকালে পুলিশ, স্থানীয় নেতারা এলাকায় গেলে, তাঁদের উপর হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে। হামলা চলে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতেও। ঘটনার পরে প্রাথমিক ভাবে খুনের মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করেছিল পুলিশ। আদালতের নির্দেশে পকসো ধারা যুক্ত করা হয়। ঘটনার দ্রুত তদন্ত করে শাস্তির আশ্বাস দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পরেই ঘটনার তদন্তে সিট গঠন করা হয়। ঘটনার ২৬ দিন পর, গত ৩০ অক্টোবর চার্জশিট পেশ করে তদন্তকারী দল। ৫ নভেম্বর থেকে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। মোট ৩৬ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল ওই মামলায়। বৃহস্পতিবার মূল অভিযুক্ত মুস্তাকিনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন বারুইপুরের ফাস্ট অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট জাজেস কোর্টের বিচারক সুব্রত চট্টোপাধ্যায়। শুক্রবার রায় ঘোষণা করেন। পাশাপাশি, মৃতার পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। মামলার রায়দানের পর সরকারি আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘নৃশংস ঘটনা। বিরল ঘটনা। তাই ফাঁসির আবেদন করেছিলাম আমরা। বিচারক দোষীকে ফাঁসির সাজাই দিয়েছেন। এই মামলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ডিএনএ প্রোফাইল মিলে গিয়েছে। ফলে সন্দেহের আর কোনও অবকাশই থাকে না।’’ চার মাস কেটে গেলেও আরজি কর-কাণ্ডের বিচারপ্রক্রিয়া এখনও চলছে। অন্য দিকে, মাত্র ৬৩ দিনের মাথায় বিচার এল জয়নগরকাণ্ডে।
শাসকের এই প্রতিক্রিয়া নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বলে দাবি করেছেন রাজ্যসভার বাম সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। একই সঙ্গে জয়নগরের ঘটনার সঙ্গে আরজি করের ঘটনাকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেন। কাশবাবু বলেন, ‘আরজি করের ঘটনার সঙ্গে জয়নগরের ঘটনার তুলনা করা মানে বাজারের আলুর সঙ্গে আকাশের চাঁদের তুলনা। আরজি করের ঘটনা ঘটেছে সরকারি হাসপাতালে। সেখানে অভিযুক্ত সরকারি সিভিক ভলান্টিয়ার। সেখানে সরকার নিজের পিঠ বাঁচাতে তথ্যপ্রমাণ লোপাট করেছে তাও তদন্তে স্পষ্ট। নইলে টালা থানার ওসিকে এতদিন জেলে আটকে রাখত না পুলিশ। আরজি করের ঘটনা প্রমাণ করা অনেক কঠিন। কারণ সেখানে কেউ ঘটনা ঘটতে দেখেনি। জয়নগরের ঘটনায় মেয়েটিকে অভিযুক্তের সঙ্গে লোকে দেখেছে। তার গতিবিধি সম্পর্কেও সবাই অবহিত ছিল। সাক্ষপ্রমাণ ছাড়া সাজা হয় না। কামদুনিতে নিম্ন আদালতে ফাঁসির সাজা হয়েছিল। হাইকোর্ট প্রমাণের অভাবে সেই সাজা মকুব করে দিয়েছে।’ আরজি কর কাণ্ডে তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে হয়েছে যে ধর্ষক ও খুনির ফাঁসি হওয়া উচিত। কিন্তু জয়নগর কাণ্ডে তাঁর পুলিশ যে গতিতে কাজ করেছে তা নিয়ে উচ্চতর আদালতে প্রশ্ন উঠতে পারে। শুধু কি দোষীকে সাজা দেওয়া, না কি আরজি কর কাণ্ডে জনরোষ কমাতে প্রশাসন যে অতি তৎপরতা দেখিয়েছে?