‘সুশান্ত ঘোষ গুন্ডা হ্যায়’! কাউন্সিলর ‘ঘনিষ্ঠ’ আততায়ী! সুশান্তকে খুন করতে মুঙ্গের থেকে অস্ত্র আনে
‘সুশান্ত ঘোষ গুন্ডা হ্যায়’! উড়োচটিতে নাকা চেকিংয়ের সময় ধরা পড়া আফরোজ়কে গলসি থানায় আনা হয়। পুলিশ সূত্রে খবর, দক্ষিণ কলকাতার রুবি হাসপাতাল লাগোয়া আনন্দপুর এলাকার গুলশান কলোনিতে থাকেন আফরোজ়। সেখানে তাঁর জমি-বাড়ি রয়েছে। সেই জমি নিয়ে বিবাদ ছিল স্থানীয় এক জনের সঙ্গে। তিনি পেশায় প্রোমোটার। জেরায় পুলিশকে আফরোজ় জানিয়েছেন, ওই প্রোমোটার সুশান্তের অনুগামী। কাউন্সিলরের ‘ভয় দেখিয়ে’ সম্প্রতি তাঁর জমি দখল করে ফ্ল্যাট বানানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। তা মেনে নিতে পারেননি আফরোজ়। তখনই সুশান্তকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে জেরায় পুলিশকে জানিয়েছেন তিনি। এমনটাই খবর পুলিশ সূত্রে। গলসি থানা থেকে বেরোনোর সময় তিনি বলেন, ‘‘সুশান্ত ঘোষ গুন্ডা হ্যায়! মেরা জায়গা দখল কিয়া হ্যায় তো মারা হ্যায় (আমার জায়গা দখল করেছিল, তাই মেরেছি)।’’
তৃণমূল কাউন্সিলরের উপর হামলা। চাঞ্চল্যকর দাবি গোয়েন্দাদের। হামলার মাস্টারমাইন্ড মহম্মদ ইকবাল ওরফে গুলজার নয়, এর পিছনে অন্য কেউ! অনুমান তদন্তকারীদের। কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ কেউ এর পিছনে? হামলার ঘটনায় হামলাকারী যুবরাজ-সহ তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। ধৃতদের মধ্যে রয়েছে ট্যাক্সিচালক আহমেদ খান। গুলজারকে বর্ধমান গলসি থেকে শনিবার গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হামলার জন্য মুঙ্গের থেকে সুপারি কিলাররা আগ্নেয়াস্ত্রও নিয়ে এসেছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসছে। সুশান্তবাবুর বাড়ির সামনে সরেজমিনে তদন্ত করতে যান পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা।
কসবার কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষকে খুনের চেষ্টায় মূল ষড়যন্ত্রী হিসেবে গুলজার বলে একজনকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করছিল তদন্তকারীরা। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায়, সুশান্ত ঘোষের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তির সঙ্গে গুলজারের সুসম্পর্ক ছিল। কাউন্সিলররের ওই ঘনিষ্ট ব্যক্তি বিহার থেকে আসা সুপারি কিলার যুবরাজ-সহ তিনজনকে লেক টাউনে এক হাউজিংয়ের ফ্ল্যাটে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তদন্তকারীদের অনুমান, মাস্টারমাইন্ড অন্য কেউ। গুলজারের মাধ্যমে কার্যসিদ্ধির চেষ্টা করা হয়েছে।
কাউন্সিলরকে খুনের ছক কষা হয়েছিল একমাস আগে থেকে। দুটি টিম তৈরি হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথম টিমের কাজ ছিল কাউন্সিলরকে ভয় দেখানো। এই কাজের দায়িত্ব যুবরাজকে দেওয়া হয়েছিল। পিছনে আর একটি বাইকে থাকবে দ্বিতীয় টিম। পিস্তল নিয়ে ভয় দেখিয়ে যুবরাজ সেখান থেকে পালিয়ে গেলে তার পিছনে থাকা দ্বিতীয় টিম এসে সুশান্তবাবুর উপর গুলি চালিয়ে সেখান থেকে সোজা ভিন রাজ্যে পালিয়ে যাবে। পরিকল্পনা মাফিক যুবরাজ শুক্রবার ভর সন্ধ্যায় বাড়ি সামনে ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা ১২ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান সুশান্ত ঘোষকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে যায়। কিন্তু গুলি চালাতে গিয়ে ধরা পড়ে ওই যুবক। জেরা করে আহমেদ খান নামে এক ট্যাক্সি চালককেও গ্রেপ্তার করা হয়। ধৃতদের জেরা করে ইকবালের নাম উঠে আসে।
মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্য সুশান্তকে খুনের চেষ্টা করেছিলেন আততায়ীরা। আর হাতে হাতে আড়াই হাজার টাকা পাবেন। ওই প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর বিহার থেকে দুই সঙ্গীকে নিয়ে কলকাতায় আসেন যুবরাজ। তার পর পরিকল্পনামাফিক ঘটনাস্থলে পৌঁছন তিনি। পুলিশকে এমনই জানিয়েছেন ধৃত ‘শুটার’। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আরও জানিয়েছেন, কাউন্সিলরকে ‘ভয় দেখানোর’ জন্য তাঁকে সুপারি দিয়েছিলেন ইকবাল ওরফে আফরোজ। ব্যবসা করেন। কিসের ব্যবসা? বালি-সিমেন্টের সিন্ডিকেটে যুক্ত। আবার, চপ্পল তৈরির বাতিল দানা কিনে ব্যবসা করতেন। আলু ব্যবসায়ী! পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, আফরোজ়ের অপরাধের কোনও অতীত নেই। এমনকি, স্থানীয় কোনও অপরাধ গ্যাংয়ের সঙ্গেও জড়িত নন। কলকাতার বুকেই তাঁর আর একটি বাড়িরও খোঁজ মিলেছে। তাঁর কাছ থেকে যে নাইন এমএম পিস্তলটি পেয়েছে পুলিশ, সেটিও ইকবালই তাঁকে দিয়েছিলেন।
তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, বছর চল্লিশের ইকবাল আসলে আফরোজের ছদ্মনাম। ঝাড়খণ্ডের জামুয়ার বাসিন্দা। বেশ কয়েক বছর ধরে সে পঞ্চাননতলা গুলশন কলোনিতে বাস। এখানে সে গুলজার নামে পরিচিত। গুলজার বিহারের বৈশালি থেকে সুপারি কিলারদের ভাড়া করে নিয়ে এসেছিল। বিহার থেকে মোট তিনজনকে এই কাজে ভাড়া করা হয়েছিল। তার মধ্যে একজন মাস খানেক আগে কলকাতায় এসে পৌঁছয়। গুলজার তাকে কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। পুলিশ সূত্রে খবর, পরিকল্পনা মাফিক হামলার আগের দিন বৃহস্পতিবার বিকেলে বিহার থেকে যুবরাজ-সহ দুজন হাওড়ায় আসে। গুলজারের কথা মত তাদের নিতে হাওড়ায় যায় বিহার থেকে আগে চলে আসা ওই যুবক। ওই তিনজনকে লেকটাউনের ১৪৫, কালিন্দি হাউজিং স্টেটের ফ্ল্যাটে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
লালবাজার সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই তিনজনকে লেকটাউনে যে ফ্ল্যাটে রাখা হয়েছিল তা সুশান্তবাবুর ঘনিষ্ঠ লোকই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। গুলজার তাঁকে বলেছিল, বিহার থেকে তাঁর পরিচিতরা চোখের অস্ত্রোপচার করাতে কলকাতায় আসছে। মোট তিনজন আসবে। কলকাতায় কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক। সেইমত সুশান্ত- ঘনিষ্ঠ ওই ব্যক্তি লেকটাউনে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তবে এই তথ্য কতটা সত্য, তা গোয়েন্দারা যাচাই করে দেখছেন। পাশাপাশি, ধৃতদের অতীত জানতে বিহার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে কলকাতা পুলিশ। তিন আততায়ীকে কলকাতায় থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন সুশান্তেরই ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ী! তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, সুশান্ত-ঘনিষ্ঠ ওই ব্যবসায়ী শুক্রবারের গুলিকাণ্ডের ‘মূল ষড়যন্ত্রকারী’ আফরোজ় খান ওরফে গুলজ়ারেরও ‘ঘনিষ্ঠ’! তা হলে কি সুশান্তকে খুন করার পরিকল্পনার সঙ্গে ছিলেন তাঁরই পরিচিত ওই ব্যবসায়ী? যদিও তাঁর দাবি, কাউন্সিলরকে খুনের পরিকল্পনার ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গ জানতেন না তিনি। সব মিলিয়ে এক গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছেন তদন্তকারীরা। এদিকে, যুবরাজের জন্য অন্য একটি স্কুটারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই স্কুটারে চেপেই ঘটনাস্থলে পৌঁছন যুবরাজ। এখনও অধরা সেই স্কুটারচালক।
সুশান্ত ঘোষকে ফোন করে খোঁজখবর নিয়েছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে ফোন করেন দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানিয়েছেন, দল পাশে আছে। মমতার ফোনের কথা জানিয়েছেন সুশান্তবাবু নিজেই। কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম পুলিশকে নিশানা করে কড়া বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি সুশান্তবাবুর রাজডাঙার বাড়িতেও যান। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে পাশে থাকার আশ্বাস দেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানিয়েছেন, দল সুশান্তর পাশে আছে।