November 2, 2024

ভোর ০৪:০৩-০৪:৩১, ধর্ষণ করে খুন ২৮ মিনিটে! আরজি কর-কাণ্ডে ধৃতের বিরুদ্ধে মোট ১১টি ‘প্রমাণ’, সিবিআই চার্জশিট

0

আরজি করে মহিলা চিকিৎসক পড়ুয়ার খুন এবং ধর্ষণের মামলায় এখনও পর্যন্ত তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে সিবিআইয়ের দাবি,ঘটনায় মূল অভিযুক্ত একজনই। আরজি করের মহিলা চিকিৎসক-পড়ুয়ার খুন এবং ধর্ষণের মামলায় সোমবার শিয়ালদহ আদালতে প্রথম চার্জশিট জমা দিয়েছে সিবিআই। সেই চার্জশিটে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা দাবি, ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত এক জনই। ঘটনার ১২ ঘণ্টার মধ্যে কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া সেই সিভিক ভলান্টিয়ারের নামই ‘মূল অভিযুক্ত’ হিসাবে উল্লেখ করে সিবিআইএর দাবি,৯ আগস্ট ভোর ৪টে ০৩ মিনিট থেকে ভোর ৪টে ৩১ মিনিট— এই ২৮ মিনিটে সেমিনার রুমের মধ্যে ওই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন ধৃত সিভিক।

সিবিআই চার্জশিটে জানিয়েছে, ট্র্যাফিক পুলিশ এবং লালবাজারের কাছ থেকে সংগৃহীত সিসিটিভি ফুটেজ দেখেই অভিযুক্তের গতিবিধির প্রমাণ মিলেছে। আরজি করের ট্রমা সেন্টারে প্রবেশের মুখে লাগানো সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গিয়েছে, রাত ৩টে ৩৪ মিনিটে বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢোকেন অভিযুক্ত। তখন তাঁর পরনে ছিল টি-শার্ট এবং জিন্‌স। বাঁ হাতে ধরা ছিল হেলমেট। গলায় ঝোলানো ছিল একটি হেডফোন। ওই বিল্ডিংয়ের নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে কথা বলেই ভিতরে প্রবেশ করেন অভিযুক্ত। মিনিট দুই পরেই তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যান। আধ ঘণ্টা পরে অভিযুক্ত সেমিনার রুমে প্রবেশ করেন। ৪টে ৩১ মিনিট নাগাদ সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। ৪টে ৩২ মিনিট নাগাদ চারতলা থেকে নেমে আসেন অভিযুক্ত। সিবিআই চার্জশিটে উল্লেখ করেছে, বেরোনোর সময় অভিযুক্তের গলায় কোনও হেডফোন ছিল না। সেই হেডফোনই মূল ঘটনাস্থল থেকে পরে কলকাতা পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছিল।

আরজি কর-কাণ্ডে এখনও পর্যন্ত তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিবিআইয়ের দাবি, ওই ঘটনায় ‘মূল অভিযুক্ত’ এক জনই। অন্য দু’জন— আরজি করের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডল। সিবিআই আগেই শিয়ালদহ আদালতে জানিয়েছিল, ধর্ষণ এবং খুনের মামলায় প্রত্যক্ষ যোগাযোগের অভিযোগ নেই তাঁদের বিরুদ্ধে। ঘটনার পর তথ্যপ্রমাণ লোপাটের চেষ্টার অভিযোগে তাঁদের গ্রেফতার করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। চার্জশিটেও সেই কথাই উল্লেখ রয়েছে।

সিবিআই চার্জশিটে লেখা হয়েছে, ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারই যে আরজি করে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় জড়িত, তার বহু প্রমাণ হাতে রয়েছে। সংগৃহীত বয়ান, ভিডিয়ো এবং ফরেন্সিক বা সায়েন্টিফিক রিপোর্টের ভিত্তিতে ধৃতের বিরুদ্ধে মোট ১১টি প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। সিবিআই চার্জশিটে যে ১১টি প্রমাণ দিয়েছে, তা হল—

১. সিসিটিভি ফুটেজ থেকেই জানা গিয়েছে, গত ৯ অগস্ট ভোরে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চারতলায় গিয়েছিলেন ধৃত। সেটাই ছিল মূল ঘটনাস্থল।

২. অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার যে ওই রাতে আরজি কর হাসপাতালেই ছিলেন, তাঁর মোবাইল ফোনের লোকেশন থেকেই তার প্রমাণ মিলেছে।

৩. ময়নাতদন্তের সময় মৃতার দেহ থেকে ধৃতের ডিএনএ মিলেছে।

৪. ধৃতের যে প্যান্ট এবং জুতো পুলিশ উদ্ধার করেছিল, তা থেকে মৃতার রক্তের দাগ মিলেছে।

৫. ঘটনাস্থল থেকে যে ছোট ছোট চুল পাওয়া গিয়েছিল, তা অভিযুক্তের চুলের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।

৬. ঘটনাস্থল থেকে যে ব্লুটুথ ইয়ারফোন উদ্ধার হয়েছিল, তা ধৃতের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত হওয়া ফোনের সঙ্গেই যুক্ত ছিল। এখানে উল্লেখ করা জরুরি, ঘটনার রাতে ধৃতকে যখন ঘটনাস্থলের দিকে যেতে দেখা গিয়েছিল, তখন তাঁর গলায় ব্লুটুথ ইয়ারফোন জড়ানো ছিল। কিন্তু তিনি যখন ফিরছিলেন ঘটনাস্থল থেকে, তখন সেই ব্লুটুথ ইয়ারফোন তাঁর গলায় ছিল না।

৭. ধৃতের শরীর থেকে যে ক্ষতচিহ্ন মিলেছিল, দেখা গিয়েছে, ধৃতের মেডিক্যাল পরীক্ষার ২৪ থেকে ৪৮ ‌ঘণ্টা আগে সেই ক্ষত তৈরি হয়েছিল। অর্থাৎ, হিসাব মতো ৮ অগস্ট থেকে ৯ অগস্টের মধ্যেই তৈরি হয়েছিল সেই ক্ষত। ঘটনাচক্রে, মহিলা চিকিৎসকে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনাও ওই সময়েই ঘটেছিল।

৮. অভিযুক্তের শরীরে যে ক্ষতচিহ্ন মিলেছে, সেগুলি নির্যাতিতার প্রতিরোধের ফলেই তৈরি হয়েছিল।

৯. অভিযুক্তের মেডিক্যাল পরীক্ষা থেকে এ রকম কোনও প্রমাণ মেলেনি যে, তিনি সঙ্গমে অক্ষম।

১০. সিএফএসএল কলকাতার রিপোর্ট অনুযায়ী, ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া মৃতার অন্তর্বাসের সেলাই যে ভাবে ছিঁড়ে গিয়েছে, তা থেকে বোঝা গিয়েছে যে, সেটি জোরজবরদস্তি খোলা হয়েছে।

১১. সিএফএসএল কলকাতার রিপোর্ট অনুযায়ী, মৃতা যে কুর্তি পরেছিলেন, কোমরের কাছে সেই কুর্তির দু’পাশটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। তা টানাহেঁচড়ার কারণেই হয়েছে। সিবিআই চার্জশিটে জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে যে বীর্য এবং লালারস মিলেছিল, তা ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারেরই।

৯ আগস্ট সকালে আরজি করের চারতলায় সেমিনার হল থেকে মহিলা চিকিৎসকের রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়েছিল। তাঁকে ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগে সেই রাতেই কলকাতা পুলিশের ফোর্থ ব্যাটেলিয়নের ব্যারাক থেকে অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার গ্রেফতার হয়েছিলেন। কলকাতা পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। পরে আরজি কর-কাণ্ডের তদন্তভার পায় সিবিআই। অথচ তিনি বলেন তিনি নাকি কিছু করেননি। কিছুই জানেন না। আরজি করে ধর্ষণ এবং খুনের মামলার চার্জশিটের প্রতিলিপি পাওয়ার পর এমনটাই দাবি করেছেন ওই ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া মূল অভিযুক্ত। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসক-পড়ুয়া খুনের ঘটনায় সোমবারই আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে সিবিআই। সেই চার্জশিটের প্রতিলিপি মঙ্গলবার মূল অভিযুক্তকে দেওয়া হয়। সরকারি আইনজীবীর কাছ থেকে সই করে নেওয়া সেই প্রতিলিপি দেখে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার দাবি করেন, তিনি কিছু করেননি। তিনি কিছু জানেন না।

মঙ্গলবার ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার শিয়ালদহ আদালতে এজলাসে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘আমি কিছু বলতে চাই।’’ এর পরেই তাঁকে কাঠগড়ায় আনা হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি কিছু বলতে চাই। আগের দিনও বলতে পারিনি। কিছু বলতে না পারলে তো সব দোষ আমার উপর পড়বে।’’ বিচারক তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘‘আপনার যা বলার, সব বলতে পারবেন।’’ অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার তখন বলেন, ‘‘হুজুর, আমি কিছু করিনি। ঘটনার বিষয়ে কিছু জানি না।’’ এর পরে ধৃতকে অতিরিক্ত জেলা এবং দায়রা বিচারকের কাছে আনা হয়।

আরজি কর-কাণ্ডের ৫৮ দিনের মাথায় সোমবার শিয়ালদহ আদালতে প্রথম চার্জশিট জমা দিয়েছে সিবিআই। সূত্রের দাবি, ধর্ষণ ও খুনের মামলায় মূল অভিযুক্ত হিসাবে ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের নামের উল্লেখ রয়েছে চার্জশিটে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ (ধর্ষণ), ৬৬ (দীর্ঘ ক্ষণ সংজ্ঞাহীন থাকা অবস্থায় ধর্ষণ) এবং ১০৩ (১) (খুন) ধারায় তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সেই চার্জশিটের প্রতিলিপি মঙ্গলবার সরকারি আইনজীবী ধৃতের আইনজীবীর কাছে দেওয়া হয়েছে। সই করে তা গ্রহণ করেছেন ধৃত। তার পরেই আদালতে সিভিক ভলান্টিয়ার দাবি করেছেন, কিছুই জানেন না।

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may have missed