দু’বছর পর বোলপুরে কেষ্ট, ভীত শিবঠাকুর? অনুগামীদের ভিড়, পুষ্প বর্ষণ! ‘দিদি’র সঙ্গে সাক্ষাৎ?
রাজকুমার মণ্ডল, নয়াদিল্লি
এলাকার নাম বীরভূমের নিচুপট্টি। অনুব্রতর জামিন নিশ্চিত হতেই সাজ সাজ রব। দুই বছর দুর্গাপুজো ছিলেন না এই বাড়িতে। এ বার পুজোর আগেই বোলপুরের বাড়িতে ফিরছেন। দিল্লির রাউস এভিনিউ কোর্ট থেকে জামিন নিশ্চিত হতেই অনুব্রতর বাড়িতে শুরু হয়েছিল রং করার কাজ, ঝাড়পোঁছ, আগাছা সাফাই। দুই বছরেরও বেশি সময় পরে বীরভূমে ফিরছেন অনুব্রত মণ্ডল। প্রথমে আসানসোল সংশোধনাগারে এবং তার পর প্রায় দেড় বছর দিল্লিতে তিহাড় জেলে বন্দি। তিহাড় থেকে মুক্তির পর মেয়ে সুকন্যা মণ্ডলের সঙ্গে সোম রাতের বিমানেই কলকাতার উদ্দেশে রওনা। মঙ্গল ভোরে কলকাতায়। দমদম বিমানবন্দরে অবতরণের পর ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ সোজা বীরভূমের উদ্দেশে রওনা তৃণমূলের বীরভূম জেলার প্রাক্তন সভাপতি অনুব্রতর। সঙ্গে সুকন্যা এবং অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ কয়েক জন নেতা। সড়কপথে বর্ধমান হয়ে বীরভূমে। জেলায় অনুব্রতর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় সকাল থেকেই বোলপুরে নিচুপট্টির বাড়ির সামনে ভিড় দলীয় কর্মীদের।
বীরভূমে ফেরার পথে বর্ধমান পার করে এক জায়গায় কিছুক্ষণের জন্য থামে অনুব্রতর গাড়ি। গাড়ির কাচ নামিয়ে সাংবাদিকদের শারীরিক সমস্যা পায়ে ও কোমরে ব্যথার কথাও জানানোর পর বক্তব্য, “আমি আদালতকে সম্মান করি, আইন মেনে চলি।” সঙ্গে এ কথাও বললেন, “দিদির জন্য আছি, বরাবরই থাকব।”অনুব্রতর গ্রেফতারির পর মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “কেষ্টকে বীরের সম্মান দিয়ে ফিরিয়ে আনব।” মমতার মঙ্গলবার বীরভূম জেলায় প্রশাসনিক কর্মসূচিতে কারামুক্তির পর বীরভূমে দলনেত্রীর সঙ্গে মঙ্গলবার সাক্ষাৎ অনুব্রতর? চর্চা রাজনৈতিক মহলে। অনুব্রতর কথায় শরীর ভাল থাকলে দেখা হবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। তিহাড়-মুক্ত কেষ্ট ২০২২ সালের ১১ অগস্ট গরু পাচার মামলায় সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার। দিনটা ছিল রাখি পূর্ণিমা। গ্রেফতারির পর প্রথম দিকে তিনি ছিলেন আসানসোল সংশোধনাগারে। পরে গরু পাচার সংক্রান্ত মামলাতেই ইডিও গ্রেফতার করে আসানসোল থেকে নিয়ে যায় দিল্লিতে। রাখা হয়েছিল তিহাড় জেলে। একই মামলায় মেয়ে সুকন্যাও কিছু দিন আগে জামিন পেয়েও বীরভূমে না ফিরে দিল্লিতেই অনুব্রতর মুক্তির অপেক্ষায়। মঙ্গলে পিতা-কন্যা একসঙ্গেই বোলপুরের নিচুপট্টির বাড়িতে।
দিল্লির আদালতে গরু পাচার মামলায় জামিনে মুক্ত অনুব্রত মণ্ডল। বীরভূমে নেতার ছবি, ফ্লেক্স। এই আবহে কেমন আছেন সেই শিবঠাকুর মণ্ডল, যিনি অনুব্রতের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলা করেছিলেন? দুবরাজপুরের বালিজুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান জানালেন, তিনি আনন্দিতও নন, দুঃখিতও নন। তাঁর কোনও ভয় নেই। কারণ, মানুষকে তো এক দিন মরতেই হবে! অনুব্রত-কন্যা সুকন্যাকে গ্রেফতার করা ঠিক হয়নি বলে দাবি করেছেন শিবঠাকুর। এই নিয়ে কটাক্ষ করেছেন কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকেও। শিবঠাকুর জানান, অনুব্রতের জামিন নিয়ে তাঁর কিছুই বলার নেই। কারণ, এটি আইনি বিষয়। তবে তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘‘আমি আনন্দিত নই, দুঃখিতও নই।’’ অনুব্রতের জেলমুক্তিতে তিনি কি ভয় পেয়েছেন? কারণ, তিনিই দুবরাজপুর থানায় অনুব্রতের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ এনেছিলেন। জামিন পেয়ে বীরভূমে ফিরছেন অনুব্রত। শিবঠাকুর মোটেও এতে শঙ্কিত নন বলে জানিয়ে বলেন, ‘‘ভয় বলে কিছু নেই। মানুষকে তো মরতেই হবে একদিন! আমি কেন ভয় করতে যাব?’’
শিবঠাকুর ছিলেন বালিজুড়ি গ্রামের প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান। শিবঠাকুর এক সময়ে তৃণমূলেই ছিলেন। শিবঠাকুর নিজে দাবি করেন, এখনও তৃণমূলই করেন। বালিজুড়ি পঞ্চায়েতের প্রধান পদে থাকার সময় তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা ওঠায় শিবঠাকুরকে বাঁচিয়েছিল দল। প্রধানের পদ ছাড়তে হয়। বহিষ্কারও করা হয় দল থেকে। বছর দু’য়েক পর আবার পঞ্চায়েত প্রধান শিবঠাকুর অভিযোগ করেছিলেন, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে অন্য দলে চলে যাওয়ার কথা ভাবনাচিন্তা করেছিলেন বলে দুবরাজপুরের দলীয় কার্যালয়ে ডেকে তাঁকে ‘গলা টিপে প্রাণে মারা’র চেষ্টা করেছিলেন অনুব্রত। অভিযোগ ঘিরে উত্তাল হয় জেলার রাজনীতি। যে দিন থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়, ঠিক তার পরের দিনই আদালতে হাজির করিয়ে অনুব্রতকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বালিজুড়ি পঞ্চায়েতের প্রধান হন শিবঠাকুরের স্ত্রী লিপিকা মণ্ডল। অনুব্রত বীরভূমে ফিরলে কি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন শিবঠাকুর? ‘‘জেলা সভাপতি ফিরছেন আমার কী? আমি দলের পদে নেই। আমি শুধু দল করি।’’ সুকন্যার গ্রেফতারি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে শিবঠাকুর বলেন, ‘‘সুকন্যার সঙ্গে বিজেপি সরকার যা করেছে, খুব নিন্দনীয়। এক জন আইবুড়ো মেয়েকে জেলে পাঠিয়েছে। ওঁকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। বিজেপি ঠিক করেনি।’’
পরনে হলুদ-ছাই রঙের টি শার্ট আর ট্রাউজার্স। দিল্লির তিহাড় জেলের ৩ নম্বর গেট দিয়ে বীরভূমের ‘ওজনদার নেতা’ অনুব্রত মণ্ডল (কেষ্ট) ‘অন্য রকম’। ওজন ঝরেছে কয়েক কেজি। বাবাকে দেখে দৌড়ে গেলেন কন্যা সুকন্যা মণ্ডল। বাবার সামনে গিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে এক জোড়া জুতো রাখলেন। যে চটি পরে তিহাড় থেকে বেরোলেন কেষ্ট, সেটা চুপচাপ খুলে রাখলেন পাশে। মেয়ের নিয়ে যাওয়া জুতোয় পা গলিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। সোম রাত ৯টা ৪০মিনিট নাগাদ বাবা-মেয়ে হাত ধরাধরি করে গাড়িতে। গাড়ি সোজা ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে রাতের উড়ানেই নিজের রাজ্যে কেষ্ট।