গোপন কিছু ‘জেনে যাওয়া’র মূল্য দিতে হল তিলোত্তমাকে? অপকর্মের সন্ধান শীর্ষ স্তরে ইমেল করতে চেয়েই কি খুন চিকিৎসক?
মেডিক্যাল শিক্ষার গোটা ব্যবস্থাই পচেগলে গিয়েছে। আমূল সংস্কার ছাড়া এ থেকে মুক্তির পথ নেই। আর জি কর হাসপাতালের সূত্র ধরে স্বাস্থ্য দফতরে যে দুর্নীতির খবর ক্রমশ সামনে। ধীরস্থির, শান্ত গোছানো স্বভাবের, যথেষ্ট তথ্য হাতে রেখেই কাজ করতেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের নিহত চিকিৎসক-পড়ুয়া সম্পর্কে তাঁর শিক্ষক-চিকিৎসক ও সতীর্থদের মূল্যায়নের ভিত্তিতেই প্রমাণ। হাসপাতাল সূত্রে খবর, ঘটনার কিছু দিন আগে কয়েক জন শিক্ষককে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর হাতে হাসপাতাল সংক্রান্ত এমন কিছু তথ্য এসেছে যা তিনি সরাসরি সরকারের শীর্ষ স্তরে পাঠাতে চান। বেশ কয়েক জনের ইমেল আইডি-ও জোগাড় করেছিলেন। কী তথ্য পেয়েছিলেন তিনি কিংবা সেই মেল শেষ পর্যন্ত পাঠাতে পেরেছিলেন কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি। কিন্তু হাসপাতালে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে অনেকেই এখন মনে করছেন, কোনও কিছু ‘জেনে যাওয়া’র মূল্য দিতে হল মৃত চিকিৎসককে?
অভিযোগ, গোড়ায় আর জি কর এবং বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল প্রশ্ন ফাঁস চক্রের রমরমা। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। তারই সঙ্গে বহু বছরের চালু ও লাভজনক ব্যবসা হিসেবে ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ এবং বদলির ব্যবস্থা। অভিযোগ, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মেডিক্যাল কাউন্সিলের দুর্নীতি। মেডিক্যাল পড়ুয়ারা সন্দীপ, অভীক, বিরূপাক্ষ ও তাদের দলবলকে যে যমের মতো ভয় পেতেন, তার কারণ শুধুই পরীক্ষা দিতে না পারা বা ইচ্ছাকৃত ভাবে ফেল করিয়ে দেওয়া নয়। মেডিক্যাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রেশন ছাড়া এক জন ডাক্তারের প্র্যাকটিস করা সম্ভব হয় না। কাউন্সিলে ছিল ওদেরই রমরমা।
অভিযোগ, কথা না শুনলেই ভয় দেখানো হত। ‘পাশ যদি করেও যাস, রেজিস্ট্রেশন নম্বর কী ভাবে পাস দেখে নেব।’ তাই নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে যাবতীয় অনিয়মের সঙ্গে আপস করতে রাজি হয়ে যেতেন অনেকেই। আর জি করে খুন ও ধর্ষণের ঘটনার পরে একটি ‘অ্যাকশন কমিটি’ তৈরি করেছিল ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য শাখা। ওই কমিটির চেয়ারম্যান, চিকিৎসক সৌরভ দত্তের কথায়, “দিনের পর দিন জুনিয়র ডাক্তারদের ভয় দেখানো হয় যে, তাদের রেজিস্ট্রেশন আটকে দেওয়া হবে। সিনিয়র ডাক্তারদের নানা অভিযোগের কথা বলে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হয়, টাকা চাওয়া হয়। এমন অনেক অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে।”
কাউন্সিল থেকেই সমস্ত মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষদের জানানো হয়েছিল, কাউন্সিল এ বার থেকে মেডিক্যাল পড়ুয়াদের নৈতিকতার ক্লাস নেবে। কারা নেবেন সেই ক্লাস? বিরূপাক্ষ এবং অভীক! কয়েকটি কলেজের অধ্যক্ষ রুখে দাঁড়ানোয় সেখানে নৈতিকতার এই পাঠ শেখানো হয়নি ঠিকই, বাকি জায়গাগুলিতে অভীক এবং বিরূপাক্ষ শিখিয়ে এসেছেন, ‘আদৰ্শ ডাক্তার কেমন হওয়া উচিত’। আর জি করের এক শিক্ষক-চিকিৎসক মাস কয়েক আগে তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের কাছে অভিযোগপত্র জমা দিয়ে জানিয়েছিলেন, পড়ুয়াদের বড় অংশের মধ্যে প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও নেই। এঁরা প্র্যাক্টিস শুরু করলে তার ফল ভয়াবহ হতে পারে। তার পর? সন্দীপ বলেছিলেন, “অধ্যক্ষ আমাকে ঠান্ডা গলায় বলেছিলেন, আপনার নিজের বা বাড়ির লোকের চিকিৎসা ওদের দিয়ে করাবেন না, তা হলেই হবে।” অভিযোগ পত্রের সমাধি সেখানেই।
পরিস্থিতি এমনই যে, স্বাস্থ্য দফতরের সব স্তরের সিদ্ধান্ত ঘিরেই এখন দুর্নীতির গন্ধ। যেমন, প্যানেলে আরও যোগ্য এবং অভিজ্ঞ প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা পদে নিয়োগ ঘিরেও বিস্তর প্রশ্ন। গত সেপ্টেম্বরে এই পদের জন্য ১৩ জনের ইন্টারভিউ হয়েছিল। তার পরে কী হল, কেউ জানে না। কয়েক মাস পরে আবার ইন্টারভিউ ডাকা হয়। এবং সেখানে অনেক বেশি অভিজ্ঞ প্রার্থীদের উপস্থিতি সত্ত্বেও এমন এক জনকে বেছে নেওয়া হয়, যিনি তার আগে মাত্র বছর দেড়েক একটি কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলেছেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী আগের ইন্টারভিউ প্রক্রিয়া বাতিল না করে নতুন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথাই নয়।
ব্যাচের পর ব্যাচ এমন ডাক্তাররা পাশ করে বেরোচ্ছেন, যাঁরা মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গই চিনে উঠতে পারেননি। শুরু থেকে অসততার পথে নিয়ে গিয়ে তাঁদের মধ্যে এমন ভাবে অপরাধী মানসিকতা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যার জেরে তাঁদের অনেকেই রোগীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন ভবিষ্যতে। একটা প্রজন্মের চিকিৎসকদের মেরুদণ্ডটাই ভেঙে দিয়েছে এই শিক্ষাব্যবস্থা। মাস দুয়েক আগে অধ্যক্ষদের একাংশের দাবি মেনে স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা পদ্ধতি বদলানো এবং সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার জন্য বৈঠক ডেকেছিল। অভিযোগ, সেই বৈঠকে সন্দীপ ঘোষ এবং করবী বড়াল এতটাই বাধা দেন যে, বৈঠক বানচাল হয়ে যায়। কেন ভিজিল্যান্স চলা সত্ত্বেও সন্দীপকে একটি মেডিক্যাল কলেজের এমএসভিপি পদে বসানো হয়, কেন আর জি করে এত বড় একটা ঘটনার পরেও তাঁকে অধ্যক্ষের পদ থেকে সরাতে এত সময় লাগে, কেন আর জি করের ঘটনার পরে এক মাস পেরোলেও স্বাস্থ্য দফতরের কাঠামোয় কোনও পরিবর্তন আনা হয় না? সাধারণ মানুষ এখন এই জবাবগুলো চাইছেন। নিজেদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার সাধারন মানুষ কাউকে দেবেন না। সরকারের সেটা না বুঝলে বিপদ আসন্ন!