October 4, 2024

‘‌উইলফুল রেপ…’! বিতর্ক এফআইআরের বয়ানে, আইনি পরিভাষায় ‘ইচ্ছাকৃত ধর্ষণ’ বিষয়টি সন্দেহজনক?

0

উইলফুল রেপ বলে কিছু হয় না। অত্যন্ত হাস্যকর ব্যাপার। এটা কোনও আইনের ভাষা নয়। পুলিশ কী করে এটা লিখল?‌ এখানেও অনেক প্রশ্ন?‌ টালা থানা। এফআইআর নম্বর ৫২। ‘ফার্স্ট কন্টেন্টস’ কলমে লেখা, ‘আননোন মিসক্রিয়েন্টস কমিটেড উইলফুল রেপ উইথ মার্ডার’। অর্থাৎ, অজ্ঞাতপরিচয় কেউ ইচ্ছাকৃত ধর্ষণ এবং খুন করেছে।

কলকাতা হাই কোর্ট এবং পরে সুপ্রিম কোর্টেরও প্রশ্ন, কেন সকাল ১০টা নাগাদ ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছে গেলেও রাত পৌনে ১২টায় এফআইআর দায়ের করা হল? মৃতদেহে যেখানে সহজেই একাধিক আঘাতের চিহ্ন দেখা গিয়েছে, সেখানে প্রথমেই খুনের ধারায় এফআইআর দায়ের না করে পুলিশ কেন অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে রাত পর্যন্ত তদন্ত চালিয়ে গেল? এফআইআর-এ লেখা হয়েছে ‘উইলফুল রেপ’। অথচ আইনি পরিভাষায় ‘ইচ্ছাকৃত রেপ’ বলেকিছুই নেই। ময়না তদন্তে লেখা হয়েছে, ‘দেয়ার ইজ মেডিক্যাল এভিডেন্স সাজেস্টিং ফোর্সফুল পেনিট্রেশন/ ইনসার্সন ইন দ্য জেনেটালিয়া, ইন্ডিকেটিং দ্য পসিবিলিটি অব সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট’। জেনেটালিয়া অর্থাৎ যোনিদ্বার দিয়ে কিছু প্রবেশ করানোর প্রমাণ মিলেছে। যৌন নির্যাতন করা হয়ে থাকতে পারে। ময়না তদন্তে সরাসরি ধর্ষণের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট জানার পরে এফআইআর করতে গিয়ে পুলিশ কী করে লিখল ‘উইলফুল রেপ’, যা এক জনই করেছে?”

দেখা যাচ্ছে, ঘটনার দিন অর্থাৎ ৯ অগস্ট রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে এফআইআরটি করা হয়েছে। ৫৭৭ নম্বর জিডি বা জেনারেল ডায়েরির ভিত্তিতে এই এফআইআর। এই ঘটনায় যে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা (আনন্যাচারাল ডেথ বা ইউডি) করে পুলিশ এগিয়েছিল, সেই ৮৬১ নম্বর ইউডি কেসেরও উল্লেখ করা হয়েছে এখানে। সেই সঙ্গে লেখা হয়েছে, ঘটনাস্থল থানা থেকে ৭৫০ মিটার দূরে। বেলা ১০টা ১০ মিনিটের আগে কোনও এক সময়ে এই খুন এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ধারা হিসেবে লেখা হয়েছে, ভারতীয় ন্যায় সংহিতার (বিএনএস) ৬৪ এবং ১০৩ (১)। নতুন আইন অনুযায়ী, বিএনএস ৬৪ হল ধর্ষণের ধারা এবং ১০৩ (১) হল এক জনের দ্বারা সংগঠিত খুনের ধারা। এফআইআরে এ-ও লেখা হয়েছে, ‘পরিবারের থেকে পাওয়া অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে এই এফআইআর। সেই অভিযোগপত্রকেই এফআইআর হিসাবে ধরা হয়েছে’।

মৃতের পরিবারের দাবি, টালা থানার ওসি-কে তাঁদের দেওয়া অভিযোগপত্রে লেখা রয়েছে, ‘আপনার কাছে একান্ত অনুরোধ, আমার একমাত্র কন্যাসন্তানকে নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর যে হত্যা করা হয়েছে, যে বা যারা এর সাথে যুক্ত, দ্রুত তদন্ত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।’ ফলে তাঁদের প্রশ্ন, পুলিশ যদি এই অভিযোগপত্রের ভিত্তিতেই এফআইআর করে থাকে, তা হলে ধর্ষক বা খুনি এক জনই ধরে নেওয়া হল কেন? মৃতার মায়ের দাবি, “প্রথম থেকে মনে হচ্ছে, আমার মেয়েকে এই ভাবে এক জনের পক্ষে মারা সম্ভব নয়। সেই কারণেই অভিযোগপত্রে যে বা যারা জড়িত লিখেছিলাম। তার পরেও কেন শুধু এক জনই অপরাধী ধরে নিয়ে এফআইআর করা হল?”

সিবিআইয়ের সূত্রের খবর, ৯ আগস্ট সকাল ১০টা নাগাদ আরজি করের এক চিকিৎসকের থেকেই ফোনে অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ প্রথম ঘটনার কথা জানতে পেরেছিলেন। ইমার্জেন্সি ভবনের চার তলায় চেস্ট মেডিসিনের সেমিনার হলে পৌঁছনোর আগেই সেখানে হাজির হয়ে গিয়েছিল পুলিশ। আরজি করের পালমোনারি মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক (ঘটনাচক্রে, নির্যাতিতা চিকিৎসকও ওই বিভাগের) সুমিত রায় তপাদার প্রথম ফোন করেছিলেন সন্দীপকে। সন্দীপ তখন স্নান করছিলেন। এর পরে অধ্যক্ষ নিজেই ফোন করেন তপাদারকে। ঘটনার কথা জানার পর সন্দীপ আরজি করের উদ্দেশে রওনা হন। হাসপাতালে যাওয়ার পথে সন্দীপ পুলিশকে ফোন করেছিলেন। পাশাপাশি, হাসপাতালের তৎকালীন সুপার সঞ্জয় বশিষ্ঠ এবং পালমোনারি মেডিসিন বিভাগের তৎকালীন প্রধান অরুণাভ দত্তচৌধুরী-সহ কয়েক জনকে ফোন করেছিলেন সন্দীপ। কলকাতা পুলিশের ডিসি (সেন্ট্রাল) ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় দাবি করেছিলেন, ৯ অগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যেই পুলিশ ঘিরে ফেলেছিল ঘটনাস্থল। কোনও ভাবেই সেই অংশে বাইরের লোক ঢুকতে পারেননি। প্রমাণ নষ্টের যে তত্ত্ব প্রকাশ্যে আসছে, তা সম্পূর্ণ ভুয়ো বলে দাবি করেছেন। সিবিআই সূত্রে প্রমাণ নষ্টের তত্ত্ব খারিজ করা না হলেও কার্যত মেনে নেওয়া হয়েছে, প্রাথমিক ভাবে সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষার ফল বলছে, পুলিশের আগে সন্দীপ সশরীরে ছিলেন না সেমিনার হলের অকুস্থলে।

সিবিআই স্ক্যানারে এক মহিলা স্বাস্থ্যকর্তার নাম উঠে আসছে। মহিলা স্বাস্থ্যকর্তা অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের অঙ্গুলি হেলনে কাজ করতেন। এমন তথ্যই পেয়েছে সিবিআই। সন্দীপ ঘোষের মদতেই এই বদলি হতো। তবে বদলি করিয়ে কেমন করে টাকা ভাগ করা হতো সেই তথ্য জানার চেষ্টা করছে সিবিআই। এইসবই দুর্নীতির টাকা বলে তথ্য পেয়েছে সিবিআই। সূত্রের খবর, সিবিআই এই বিষয়ে এগিয়ে যদি দেখে বড় টাকার দুর্নীতি রয়েছে তাহলে তা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের হাতে তুলে দিতে পারে। ইতিমধ্যেই আরজি কর হাসপাতালের দুর্নীতি নিয়ে নয়াদিল্লিতে ইডি মামলা দায়ের করেছে। সিজিও কমপ্লেক্সে সন্দীপ ঘোষকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে চলেছে সিবিআই। বাড়ির কাছে পোস্টিং পাইয়ে দিতে টাকা তোলা হতো বলে তথ্য হাতে এসেছে অফিসারদের। পুরো ব্যাপারটির মধ্যে জড়িয়ে ছিলেন এক মহিলা স্বাস্থ্য আধিকারিক। এই মহিলা স্বাস্থ্য আধিকারিকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল সন্দীপ ঘোষের।

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may have missed