রাখীবন্ধন উৎসব, পুরান ও ইতিহাসের প্রেক্ষাপট
রাখীবন্ধন উৎসব। রাখীবন্ধন নিতান্ত কোনো সামাজিক উৎসব নয়, এই উৎসবের মধ্যে নিহিত আছে ভাই-বোনের পরস্পরের হাজার বছরের ইতিহাস। সমস্ত পৃথিবীতে প্রচলিত এই উৎসব ভাই ও বোনের মধ্যে প্রীতিবন্ধনের উৎসব। হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ ও শিখরা এই উৎসব পালন করে। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব উদযাপিত হয়।
এই উৎসব নিয়ে ভারতীয় পুরানে আছে একাধিক কিংবদন্তি। প্রথমেই জানা যায়, মহাভারতে দ্রৌপদি ও কৃষ্ণের কাহিনী। আঘাত পেয়ে কৃষ্ণের কবজি কেটে রক্তপাত ঘটলে দ্রৌপদি নিজের শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে সেই ক্ষতস্থান বেঁধে দেয়। আর এর প্রতিদানেই দ্রৌপদির বস্ত্র হরণের সময় অলক্ষে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণ সেই শাড়ি দান করে দ্রৌপদিকে উপহার দেয়। সেই থেকেই ভাই ও বোনের মিলনের উৎসব রাখীবন্ধন উৎসব।
অন্য একটি মতে, একবার ছদ্মবেশে দৈত্যরাজ বলির আশ্রয়ে আসেন লক্ষ্মী তাঁর স্বামীর সন্ধানে। তখন বলিরাজ তাঁকে তার আশ্রয়ে থাকার অনুরোধ করেন। শ্রাবণ পূর্ণিমা উৎসবে লক্ষ্মী বলিরাজার হাতে একটি রাখী বেঁধে দেন। বলিরাজা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে লক্ষ্মী আত্মপরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলেন। এতে বলিরাজা মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বলিরাজা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেন।
এছাড়াও একটি প্রক্ষিপ্ত কিংবদন্তি আছে যে, একবার রাখী বন্ধনের দিন লক্ষ্মী ও সরস্বতী ভগবান গনেশের হাতে রাখী বেঁধে দেন। তারপরে গনেশের পুত্র বাবার কাছে এক বোনের জন্য প্রার্থনা করলে ভগবান গনেশ আগুন থেকে দেবি সন্তোষীর জন্ম দেন। সেই সন্তোষী প্রতি বছর শ্রাবণ পূর্ণিমায় গনেশ হাতে রাখী পরিয়ে দেন।
এ তো গেলো পুরানের কিংবদন্তি। এছাড়াও এই রাখী বন্ধনের বাস্তব একাধিক ঘটনার সাক্ষী দেয় ইতিহাস। জানা যায়,৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করলে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোজানা রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতো পাঠিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেন আলেকজান্ডারের ক্ষতি না করার জন্য। পুরু ছিলেন কাটোচ রাজা। তিনি রাখীকে সম্মান করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি নিজে আলেকজান্ডারকে আঘাত করেননি। এছাড়াও রাখী বন্ধন নিয়ে ইতিহাসে অনেক কাহিনী আছে। তবে রাখীবন্ধন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের কথা আমরা সবাই জানি।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখী বন্ধন উৎসব পালন করেছিলেন। তিনি কলকাতা, ঢাকা ও সিলেট থেকে হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলিম ভাই ও বোনকে আহ্বান করেছিলেন একতার প্রতীক হিসাবে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করার জন্য। পথের দু’ধারে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের হাতে রাখী পরিয়ে মৈত্রীর বার্তা দেন। এর পরেই অখন্ড বাংলার বার্তা দিয়ে কবি লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত গান –
‘ বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল-
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।’