February 17, 2025

বাংলার চিকিৎসাশাস্ত্রের রেনেসাঁ পুরুষের তৈরী হাসপাতাল, কি দুর্ভাগ্য! সংবাদ শিরোনামে থাকা চিকিৎসাকেন্দ্র আজ অসুরদের বাসা

0
RG kar

ডা:‌ আর জি কর। ডাক্তাববাবুর পুরো নাম রাধাগোবিন্দ কর। ইদানীং যে হাসপাতাল সংবাদ শিরোনামে সেই আর জি কর (রাধাগোবিন্দ কর) মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ইতিহাসটা জানা খুব প্রয়োজন।বেলগাছিয়া থেকে দমদম| বাড়ি বাড়ি সাইকেল চালিয়ে ঘুরছেন এক ডাক্তার। মাথায় একটা টুপি আর সাইকেলে ঝোলানো ক্যামবিসের ব্যাগ। বেশিরভাগ রোগীই গরীব। পথ্য কেনারই পয়সা নেই। তার উপর আবার ডাক্তারের ফিস! তাই রোগী দেখার সাথে সাথে প্রয়োজনে রোগীদের পথ্য কেনার পয়সাও দিচ্ছেন সেই ডাক্তারবাবু। শুনলে আশ্চর্য হওয়ার কথা, সেই ডাক্তারবাবু ততদিনে বিলেত ফেরৎ। ভাবতেও অবাক লাগে আজ একজন সাধারণ এমবিবিএস ডাক্তারেরও যখন গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা করায় অনীহা তখন বিলেতের ডিগ্রি নিয়েও এই ডাক্তার স্বেচ্ছায় অস্বাস্থ্যকর গ্রামকেই তাঁর কর্মস্থল বেছে নিয়েছিলেন।

মার্চ মাস, ১৮৯৯ সাল। প্লেগ তখন কলকাতায় মহামারীর আকার নিয়েছে। সেই সময়ে উত্তর কলকাতার অলিতে গলিতে ঘুরে রোগীদের সেবা করে চলেছেন এক আইরিশ মহিলা। জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিক পদে নিয়োজিত এক ডাক্তারও রোগীদের বাঁচাতে উত্তর কলকাতা চষে ফেলছেন| রোগ থেকে বাঁচার পরামর্শ দিচ্ছেন। পথ্য কিনতে অপারগ রোগীকে নিজেই অর্থ তুলে দিচ্ছেন। কিছুদিন পরে সেই বিদেশিনী ও চিকিৎসকের আলাপ হল। প্লেগের সংক্রমণ রুখতে ও মৃত্যুর হার কমাতে দু’জনে একজোট হয়ে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। সেই আইরিশ মহিলা হলেন ভগিনী নিবেদিতা| আর সেই চিকিৎসক কে ছিলেন? ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর| সংক্ষেপে আর জি কর|

আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের কথা এখন আর নতুন করে কিছু বলার নেই| কলকাতার বুকে সেরা সরকারী হাসপাতালের মধ্যে এটি অন্যতম| যদি প্রশ্ন করা হয় কে ছিলেন আর জি কর?‌ তাহলে অধিকাংশ বাঙালি লজ্জায় পড়বেন| বর্তমানে এই হাসপাতালেই চলে নাকি মহিলাদের শরীর নিয়ে লীলাখেলা, বিস্তর অভিযোগের পাহাড়। লক্ষ লক্ষ টাকার সিরিঞ্জ, গ্লাভস, বর্জদ্রব্যের কেনাবেচায় ঘাপলার অভিযোগ। প্রধান কালপ্রিট ডা:‌ সন্দীপ ঘোষ বলেও অভিযোগ। মাননীয়ার পদলেহন করে তিনি আজ প্রভাবশালী। ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা বলয় ও অসংখ্য বাউন্সারের ঘেরাটোপে থাকেন। শোনা যায় মুখ্যমন্ত্রীর পায়ের অস্ত্রোপচার করে তিনি নিজেকে অধিকতর প্রভাবশালী তকমায় আবৃত করেছিলেন। বিস্তর অভিযোগের ভিত্তিতে পরিচিত এই কুলাঙ্গার ডা:‌ সন্দীপ ঘোষের অঙ্গুলি হেলনে চলত, আর জি কর হাসপাতালে অবৈধ কার্যকলাপ। প্রমানস্বরূপ এরকম একজন অভিযোগের পাহাড় বহনকারী ডাক্তারকে নিজের সুরক্ষাকবচে আবদ্ধ করে রেখেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। সূত্র মারফৎ এমনও শোনা যাচ্ছে, দিনের পর দিন নির্যাতিতা, তারপর ধর্ষন করে খুন হওয়া তরুনী চিকিৎসক মৌমিতা দেবনাথ এমন কিছু জেনে ফেলেছিলেন, যে সত্যটা ফাঁস হওয়ার ভয়ে নির্মমভাবে অত্যাচার করে খুন করার পুরো ঘটনাটাই নখদর্পনে ছিল ডা:‌ সন্দীপ ঘোষের। এমন অভিযোগ করেছেন বেশ কিছু ডাক্তার। ডা:‌ সন্দীপ ঘোষ এন্ড কোম্পানি আপাতত আরজি কর হাসপাতালের, অথচ, আর জি কর অর্থাৎ ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর ছিলেন ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় চিকিৎসাশাস্ত্রের রেনেসাঁ পুরুষ| চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বাংলার মানুষের সুলভ্য করতে তিনি সারাটা জীবন লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন|


হাওড়া জেলার রামরাজাতলা স্টেশনে নেমে মিনিট পনেরোর পথ পেরোলেই পৌঁছনো যায় বেতড়ের বিখ্যাত কর বাড়িতে। রাধাগোবিন্দ করের জন্মভিটে। ১৮৫২ সালের ২৩শে আগস্ট তাঁর জন্মদিবস| বাবা দুর্গাদাস কর ঢাকায় মিডফোর্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পড়াশোনায় অসম্ভব মেধাবী রাধাগোবিন্দ কর হেয়ার স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করার পর চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাঠ গ্রহণের জন্য ১৮৮০ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন| পড়াশোনার পাশাপাশি ছিল থিয়েটারের প্রতিও ছিল তাঁর মারাত্মক টান| ১৮৮৩ সালে কলকাতা ছেড়ে স্কটল্যান্ডে পাড়ি দেন রাধাগোবিন্দ। ভর্তি হন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৮৮৭ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাবিদ্যার শ্রেষ্ঠ অলংকারে ভূষিত হলেন MRCP হয়ে। বন্ধু বান্ধব,আত্মীয়-স্বজন সকলেই বললেন তাঁকে ইংল্যান্ড-এ থেকে ডাক্তারি করার জন্য, এমন কি তাঁর শুভানুধ্যায়ী অধ্যাপকবৃন্দও তাঁকে বললেন বিলেতেই থেকে যাওয়ার কথা। কিন্তু,না, তিনি ফিরে এলেন তাঁর জন্মভূমি, মাতৃভূমিতে এই বাংলায়। একজন বিলেত ফেরত ডাক্তার হয়ে তিনি দাঁড়ালেন এই বাংলার অসংখ্য,অসহায় গরীব মানুষদের পাশে। সেইসময় চিকিৎসাবিদ্যা পড়াশোনা হত ইউরোপীয় চিকিৎসা শিক্ষায়| সমস্যায় পড়তেন সাধারণ পরিবার থেকে চিকিৎসাবিদ্যা পড়তে আসা বঙ্গসন্তানরা| তৎকালীন সময়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বাংলায় কোনও বই ছিল না। তাই ডাক্তারি পাশ করার আগেই বাংলা ভাষায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের বই লেখার কাজে হাত দেন। ১৮৭১ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম বই ‘ভিষগবন্ধু’। অন্যান্য বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘সংক্ষিপ্ত শারীরতত্ত্ব’, ‘রোগী পরিচর্য্যা’, ‘ভিষক সুহৃদ’, ‘প্লেগ’, ‘স্ত্রীরোগের চিত্রাবলী ও সংক্ষিপ্ত তত্ত্ব’, ‘সংক্ষিপ্ত শিশু ও বাল চিকিৎসা’, ‘সংক্ষিপ্ত ভৈষজতত্ত্ব’, ‘কর সংহিতা’ ও ‘কবিরাজ ডাক্তার সংবাদ’ ইত্যাদি। সব ক’টি বই লেখা হয়েছিল বাংলায়। ইংরেজি জানা ডাক্তারি ক্লাসের ছাত্ররাও তাঁর বই পড়তেন।

শুধুমাত্র চিকিৎসাবিজ্ঞানের বই লিখে যে বাংলার রোগীদের সমস্যার সমাধান নয়, তা অনুধাবন করেছিলেন রাধাগোবিন্দ। তাই ডাক্তার কর মনস্থির করলেন,এদেশের মানুষের জন্যে একটি হাসপাতাল তৈরী করবেন। কিন্তু টাকা কোথায়? ঠিক করলেন, ভিক্ষা করবেন,নিজের সব কিছু বিক্রি করে দেবেন। যেমন ভাবা,তেমন কাজ। কলকাতার বড়লোক,ধনীদের কাছ থেকে ভিক্ষা করতে শুরু করলেন। কলকাতায় তখনকার দিনের বড়লোকদের বাড়িতে কোন আনন্দ অনুষ্ঠান হলে বা তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে ডাক্তার কর সেই বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন,আর অভ্যাগত আমন্ত্রিতরা এলে ভিক্ষা চাইতেন ‘অনুরোধ, কিছু টাকা পয়সা যদি সাহায্য করেন, খুব উপকার হয়, সবার জন্য একটা হাসপাতাল তৈরি করতে পারি’। সবাই দেখছেন, একজন বিলেত ফেরত MRCP ডাক্তার মানুষের জন্য হাসপাতাল করার জন্য ভিক্ষা চাইছেন। পরিচিতরা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে,‘স্যার,ডাক্তারবাবু, আপনি!’ শ্রদ্ধায় তারা তাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করেন,আবার কেউ কেউ মুখ বেঁকিয়ে,পাশ কাটিয়ে চলেও যায় | শত অপমান সহ্য করেও নিরহঙ্কার মানুষটি হাসপাতাল তৈরির স্বপ্ন সার্থক করার জন্য নির্দ্বিধায় অর্থ সাহায্য চাইতেন। শুধু তাই নয়, চিকিৎসক হিসেবে অর্জিত অর্থের সমস্তটাই দান করে গিয়েছেন মেডিক্যাল স্কুল ও হাসপাতাল স্থাপনে।

এইভাবেই ভিক্ষা করে,নিজের যাবতীয় সব বিক্রি করে ২৫ হাজার টাকায় বেলগাছিয়ায় ১২ বিঘে জমি কিনে নেন ডাক্তার কর | এরপর ৭০ হাজার ব্যয়ে সেখানেই গড়ে উঠল হাসপাতাল। শয্যাসংখ্যা ৩০। ঠিকানা, ১ নম্বর বেলগাছিয়া রোড। হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে ১৮ হাজার টাকা দান করেন স্বয়ং প্রিন্স অ্যালবার্ট ভিক্টর। তাই হাসপাতালের নাম রাখা হয় ‘অ্যালবার্ট ভিক্টর হাসপাতাল’। ১৯০৪ সালে রাধাগোবিন্দের উদ্যোগের সঙ্গে মিশে যায় কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস অব বেঙ্গল। তারও ১০ বছর পর মেলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন। আত্মপ্রকাশ করে বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজ। কিন্তু সেই নাম বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯১৬ সালের ৫ জুলাই মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতল ভবনের উদ্বোধন করেন লর্ড কারমাইকেল। তাঁর সম্মানে বদলে যায় নাম। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ হিসেবেই পরিচিত ছিল এই চিকিৎসা শিক্ষা কেন্দ্রটি। ১৯৪৮ সালে তীব্র আর্থিক সঙ্কটের সময় ফের নাম বদলের দাবি ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় অবশ্য তা হতে দেননি। তাঁর উদ্যোগেই ডাঃ রাধাগোবিন্দ করের নামেই কলেজের নাম রাখা হয়।

রোগীকে যাতে চড়া দাম দিয়ে বিদেশি ওষুধ কিনতে না হয়, সে দিকেও ছিল তাঁর কড়া নজর| আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আত্মজীবনী ‘লাইফ অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্সেস অব আ বেঙ্গল কেমিস্ট’ থেকে জানা যায়, দেশের প্রথম ফামার্সিউটিক্যাল সংস্থা তৈরির সময়ে দেশীয় পদ্ধতিতে ওষুধ তৈরির কাজে রাধাগোবিন্দ করের অবদান। ১৯১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাধাগোবিন্দ কর। মৃত্যুর সময়ে রাধাগোবিন্দ করের নিজস্ব সম্পত্তি বলতে কিছুই ছিল না। শুধু ছিল বেলগাছিয়ায় গড়ে তোলা একটি বাড়ি। সেই বাড়িটিও উইল করে দান করে যান মেডিক্যাল কলেজকে। রাধাগোবিন্দ কর ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রকৃত রেনেসাঁ পুরুষ।

আজ সত্যিই আধুনিক প্রজন্মের মাথা লজ্জায় নত। এইরকম একজন মহাপুরুষ ডাক্তারের তৈরী হাসপাতলে ঘটছে নারকীয় ধর্ষন ও খুনের ঘটনা। অভ্যন্তরে দিনের পর দিন চলেছে মহিলাদের নিয়ে র‌্যাকেট চলার বিস্তর অভিযোগ। নেপথ্যে পৈশাচিক চেহারার প্রভাবশালী ডাক্তার সন্দীপ রায় এন্ড কোং।

যাঁর অসীম ক্ষমতার রক্ষাকবচ রাজ্যের সর্বোচ্চ পদে থাকা একজন মহিলাই। মহামান্য হাইকোর্টের বৃহত্তর প্রশ্নের সম্মুখীন, এরকম কর্মকাণ্ডে জড়িতে থাকে কেউ একজনও পুরস্কৃত হন?‌ মহাপুরুষের নামধারী হাসপাতালে অবস্থান করছে ‘‌অসুরসম’‌ মানসীকতার ক্রিয়েচার, সত্যিই বিরাট প্রশ্ন?‌

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may have missed