আশ্বাসের এত অভাব হয় কেন? ‘শুধু খেলা আর খেলা’ রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, দলপোষণ, স্বার্থলোভ, রাজনৈতিক ফন্দি
মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, আর জি কর কাণ্ডের অপরাধীরা দ্রুত ধরা পড়বে। শুনে প্রাথমিক ভাবে আশ্বস্ত লাগতে পারত। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর জানা দরকার, তাঁর রাজ্যে এমন কথায় ‘কোনও এক কারণে’ এই মুহূর্তে অধিকাংশ নাগরিকই আশ্বস্ত বোধ করেন না। রাজ্যের সর্বোচ্চ নেত্রী ও কর্ত্রী যখন তদন্তে গতি আনার কথা বলেন, অভিযুক্তের চরম শাস্তির কথা বলেন, তার পরও আশ্বাসের এত অভাব হয় কেন? যে পুলিশ-প্রশাসনের হাতে কয়েকটি গুরুতর দিনে তিনি এই তদন্তের ভার ছেড়ে রাখছিলেন, তার উপর রাজ্যবাসীর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। আর জি কর ঘটনায় ইতিমধ্যেই যা যা ঘটে গিয়েছে, তাতে সংশয়ের বিস্তর জায়গা যে রাজ্য প্রশাসনের তরফে সত্য খুঁজে বার করার থেকে সত্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টাটাই বেশি। এক তরুণীর উপর নৃশংস অত্যাচারের নানা প্রমাণ চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও কেন এই ঘটনাকে প্রথমেই আত্মহত্যা বলে বর্ণনা করা হল? হাসপাতাল অঙ্গনে ঘটে যাওয়া তরুণী ছাত্রীর এমন নৃশংস হত্যা দেখেও কেনই বা কর্তৃপক্ষ গোড়ায় মৃতার দায়িত্বের কথা তুললেন? কেন তদন্ত ভাল ভাবে শুরুর আগেই এক জনই হত্যাকারী বলে দাবি করা হল? পুরনো বক্তব্য কি পেশ করা হয়েছিল কোনও চাপে পড়ে? কার চাপ, কত ‘বড়’ সেই চাপ? কাকে বাঁচানোর চাপ? সে চাপ কি এতই বড় যে, অধ্যক্ষকে সরিয়ে দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে আবার অন্য হাসপাতালের শীর্ষকর্তা হিসাবে বহাল না করে উপায় থাকে না? এই চাপ কি রাজ্যবাসীর অচেনা বলে মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী? কী ভাবে তিনি আশা করছিলেন, তাঁর আশ্বাসবাক্যে মানুষ ‘ভুলবেন’? কী ভাবে রাজ্যবাসী বুঝতেন যে মৃতার পরিবারের উপর কিংবা অভিযুক্ত ব্যক্তির উপরও ‘চাপ’ কাজ করছে না?
এই আশ্বাসের হিমালয়সমান অভাব আজ পশ্চিমবঙ্গের বাস্তব, যে কারণে সিবিআই তদন্তের ভার নেওয়ায় হাঁপ ছাড়ছেন রাজ্যবাসী। আর জি কর ঘটনা আবারও বুঝিয়েছে, এই রাজ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে ঘরের ছেলেমেয়েরা যখন পড়তে বা কাজ করতে যায়, তারা কতটা অনিরাপদ। কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের সেমিনার কক্ষে এক তরুণী চিকিৎসকের ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত মৃতদেহ মিলল। প্রতিবাদরত ছাত্রছাত্রীদের এক জনের হাতের কাগজে দেখা গেল একটি প্রশ্ন— আমাদের দেশে ঘর, বাহির, এমনকি হাসপাতালও তা হলে সুরক্ষিত নয়? এর দায় কার? কী করে ঘটনাটির যথাযথ তদন্তের আগেই মেয়েটির মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে আখ্যা দিলেন পুলিশ কর্তা? এ রাজ্যে যে কোনও গুরুতর নারী-নির্যাতনের ঘটনাকে লঘু করে দেখানোর যে জঘন্য চেষ্টা, আবারও তাই ঘটল। হাঁসখালির কিশোরী, সন্দেশখালির গৃহবধূ থেকে কলকাতায় কর্মরত চিকিৎসক, সকলের ক্ষেত্রেই সত্য ঘটনার প্রকাশের চাইতে শাসক দলের তৈরি বয়ানকে সত্য বলে চালানোর চেষ্টাই বেশি। এই অপচেষ্টাকে সর্বশক্তিতে পরাভূত করা চাই।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মেনে নিতে হবে যে, নিরাপত্তাবোধের এই অভাব, প্রশাসনের প্রতি এই আশ্বাসহীনতা তিনি ও তাঁর সরকার গত এক দশকে যত্নসহকারে তৈরি করে তুলেছেন। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, দলপোষণ, স্বার্থলোভ, রাজনৈতিক ফন্দি: এ সবের বাইরে গিয়ে তাঁর পুলিশ কোনও ‘নিরপেক্ষ’ তদন্ত করতে পারে, তা আজ আর বিশ্বাস্য নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর হত্যারও যে কোনও বিচার ও শাস্তিই হয় না, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগিং-কাণ্ডই তার যথেষ্ট প্রমাণ। রাজ্য জুড়ে ডাক্তাররা যে কাজ বন্ধ রেখে উষ্মা প্রকাশ করছেন, তার অন্তর্নিহিত গুরুত্ব সরকারকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে, পশ্চিমবঙ্গকে তাঁরা কোথায় নিয়ে গিয়েছেন যে ভারতের অন্যত্রও ডাক্তারদের বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।
আর এদিকে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের নাচাগানা। তারস্বরে হিন্দি ভাটিয়ালি ভোজপুরির নাচন কোদন। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যায়ে বলিউড টলিউড থেকে সুপার স্টার গায়ক গায়িকাদের নিয়ে অনুষ্ঠান কি বন্ধ রাখা যেতো না। শুধুমাত্র মধ্যরাতে পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার দিনটিকে উদযাপন করা যেতো না? দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দের প্রতিযোগীতা বজায় রাখতে উড়ল টাকার ফোয়ারা। দলের নেতা কোটি ছুঁই ছুই খরচ করে নন্দনকান্তি আনলেন বলিউডের সুপার সিঙ্গার। পাল্লা দিতে কবোজ পাটোয়ারী টলিউডের সুপারস্টারকে ঢেলে দিলেন লক্ষ লক্ষ টাকা। আর পরস্ত্রীর দক্ষ প্রেমীক মিশুনবাবু উপভোগ করলেন ঘুরে ঘুরে। আবেগঘন দিনে বন্ধ রাখা যেতো না এই ফুর্তির অনুষ্ঠান? না পারেন নি তিনি। বন্ধ রাখতে পারেন নি স্বাধীনতা দিবসের ফেস্টিভ্যাল বন্ধ রাখতে।
অথচ এই মূহুর্তে এমন একটি দুঃস্বপ্নসম কাণ্ডের অপরাধীদের আড়াল করার জন্য যে ‘সিস্টেম’ সদাসচেষ্ট বলে অনুমান, সেই সিস্টেম-এর বাইরে থেকে কাজ করতে চলেছে সিবিআই। কলকাতা হাই কোর্টের রাজ্য প্রশাসনের প্রতি কঠোর ভর্ৎসনাও মনে করিয়ে দেয়, যখন শাসনবিভাগ অপদার্থ, দুর্নীতিপরায়ণ এবং অপরাধ-প্রশ্রয়কারী, বিচারবিভাগই একমাত্র ভরসা। তবে, রাজ্য না কেন্দ্র, সরকার না বিরোধী, এই তরজার রাজনীতি এই মুহূর্তে বিবমিষা উদ্রেককারী। এখন একমাত্র কাম্য, সম্পূর্ণ সত্যের উদ্ঘাটন। অপরাধী যে বা যারা, তাদের দ্রুত ও কঠোর বিচার ও শাস্তি। কোনও দল নয়। একমাত্র ছাত্রছাত্রীরাই পারবেন এই বিভীষিকা থেকে মুক্তি আনতে। খেয়াল রাখতে হবে এর মধ্যে কোনও দলীয় পতাকার অনুপ্রবেশ না ঘটে। কোনও বেনোজল না থাবা বসিয়ে দেয়?