এ কোন সমাজ? রাতের চেয়েও অন্ধকার! শাসকের গাত্রবর্ণ বদলে দেওয়ার স্বাধীনতা চাননি, চেয়েছিনু শাসকের ভাবনার শাসন থেকে মুক্তি! তা হয়নি
স্বাধীনতা হীনতায় ভুগছি আমরা। সত্যিই বড়ই নিষ্ঠুর এই সমাজ। নারী, শিশু, ছাত্র প্রত্যেকেই নিরপত্তাহীনতার শিকার। বুকে দুরু দুরু। মনে নিস্তব্ধতার অমনিষা। বারে বারে মনে রনেনে আঘাত হানতে সচেষ্ট দুষ্কর্মের আভিঘাত। নিরপত্তাহীনতার পরাধীনতায় সদ্য পেরিয়া যাওয়া রাতেও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত নয়। সাদা পেষাকের পুলিশ যেন মনে হয় ‘ফুলিশ’। সাতাত্তর বছর আগে বহু সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত এই স্বাধীনতা আমাদের মাথা তুলে বাঁচার অধিকার দিয়েছিল। উৎসবে, অনুষ্ঠানে, সুশোভিত মঞ্চের জ্ঞানগর্ভ ভাষণের মিথ্যা সাজসজ্জায় ভরপুর এক দিবস। স্বাধীনতা, তুমি কার? আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের যে তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়া তাঁর নিজের শিক্ষাঙ্গনে নিশ্চিন্ত নিরাপত্তায় বাঁচার অধিকার পেলেন না, তাঁর? না কি, তাঁর শরীরে যথেচ্ছ লুটপাট চালিয়ে প্রাণ কেড়ে নেওয়া এক বা একাধিক বিকৃতকাম নরাধমের? স্বাধীনতা, তুমি কি সেই ‘ক্ষমতাধর’দের, যারা ধর্ষিতা ও নিহত মেয়েটির বাড়িতে ফোন করে বলতে পেরেছিল, তিনি নাকি আত্মহত্যা করেছেন! তুমি কি সেই পুলিশদের স্বাধীনতা, যারা মেয়েটির দেহ ময়নাতদন্তের পরে হাসপাতালে অপেক্ষমাণ মা-বাবাকে না-জানিয়েই তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অধিকার ফলায়? তুমি কি কলেজের সেই অধ্যক্ষের স্বাধীনতা, যাঁকে ‘আশ্রয়’ দিতে খোদ সরকার কোল পেতে দেয়? আর জি করের ঘটনার হাড় হিম করা অনুভব এখনও আমাদের বোধকে স্তম্ভিত করে রেখেছে। আমরা সঠিক জানি না, ধর্ষক ও খুনি এক জন, না একাধিক। জানি না, ঘটনায় ধৃত অমানুষটি কোথা থেকে কার বরাভয়ে পুষ্ট হচ্ছিল। আশ্চর্য লাগে, এই রকম ঘৃণ্য কীটের পরিচয় প্রকাশ করতে পুলিশ ঢোঁক গিলেছে! কেন? কিসের শঙ্কা? কিসের ক্লেশ? হাঁড়ির মুখ বন্ধ রাখতে চাওয়ার এই অপচেষ্টা কিসের ইঙ্গিত? কাউকে আড়াল করার? সরল সত্যি হল, হনুমানের বুক চিরে ‘রাম’ দেখানোর কাহিনির মতোই সিভিক-দের পোশাকের নীচে আরও একটি অদৃশ্য জামা থাকে। সেই জামাটি ঔদ্ধত্যের, যথেচ্ছাচারের ছাড়পত্র। ১৭৮৪ সালে বার্লিন জার্নালে ইমানুয়েল কান্ট লিখেছিলেন তাঁর সুবিখ্যাত প্রবন্ধ ‘হোয়াট ইজ় এনলাইটেনমেন্ট’। ক্ষুদ্র কিন্তু ক্ষুরধার ওই প্রবন্ধে কান্ট ব্যাখ্যা করেছিলেন ‘আলোকপ্রাপ্তি’র স্বরূপ। লিখেছিলেন: এই আলোকপ্রাপ্তির জন্য তেমন কিছু চাই না, চাই শুধু স্বাধীনতা। কেমন সেই স্বাধীনতা? ‘ইহাঁ সব কুছ চলতা হ্যায়’, এই মানসিকতাই সর্বনেশে!
এখন আমরা বিভিন্ন মিছিলে পা মেলাচ্ছি। বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদের ঝড় তুলছি। আমাদের রাগ রাজপথে এসে পড়েছে। কিন্তু যত ক্ষণ না উপরোক্ত প্রশ্নগুলির সঠিক জবাব পাচ্ছি বা প্রতিটি ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা তৈরি করতে পারছি, তত দিন এই ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সাময়িক প্রতিবাদের ঝড় উঠবে। সঠিক প্রশ্নগুলি সঠিক জায়গায় সঠিক ভাবে এবং সঠিক সময়ে করা প্রয়োজন। রাষ্ট্র এই প্রশ্নের উত্তরগুলি দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ। আজকের প্রতিবাদ যেন আমরা কাল ভুলে না যাই। বৈচিত্রের মধ্যে একতা’ থেকে তাঁরা বৈচিত্রকে ছুড়ে ফেলতে চাইছেন, প্রতিষ্ঠা চাইছেন এক সমসত্ত্ব, উগ্র ‘এক’-এর। জনজাগরণ বুঝি এই ভাবেই ঘটে। দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষমতার দাপটে অন্যায়, অবিচার, লাঞ্ছনা, নিপীড়ন সহ্য করতে করতে এক দিন ছাইচাপা আগুন জ্বলে ওঠে। তার স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে ওই দিগন্তরে। দম-বন্ধ-করা ক্ষোভ আর প্রতিবাদের যে সমিধ সঞ্চিত হচ্ছিল সমাজের পরতে পরতে, তা মুহূর্তে সেই স্ফুলিঙ্গের স্পর্শে বহ্নিমান হয়, ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলার আহ্বান ধ্বনিত হয় অমৃতের পুত্রকন্যাদের উদ্দেশে। ২০২৪ সালের ১৪-১৫ অগস্টের সন্ধিকালে রাত্রি দখল করার আহ্বান জানিয়েছেন যাঁরা, তাঁরা এ-রাজ্যের কন্যা। মহানগরের সীমানা অতিক্রম করে দ্রুত, অতি দ্রুত রাজ্যের সমস্ত অঞ্চলে অগণন হৃদয়ের দখল নিয়েছে সংক্ষিপ্ত এবং সুতীব্র ধ্বনি: ওঠো, জাগো, সমবেত হও। ভয়াবহ, মর্মান্তিক এবং পৈশাচিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই রাত্রি দখলের মহা-আয়োজন, তার পরতে পরতে বিভীষিকার সহস্র উপকরণ মজুত আছে, যার এক বিরাট অংশই দৃশ্যত এখনও চোখের আড়ালে, ক্ষমতাবানদের প্রচণ্ড তৎপরতায় হয়তো শেষ অবধি চোখের আড়ালেই থেকে যাবে। কিন্তু সেই পিশাচলীলা এবং তার পরবর্তী ঘটনাক্রম থেকে একটি দগদগে সত্য আবার, আরও এক বার, সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়েছে। এই সমাজে নারীর প্রতিনিয়ত অসম্মানের সত্য। সেই অসম্মানের নানা রূপ, নানা মাত্রা। প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলনও গতানুগতিকতার বলয় থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে পারে না। সেই কারণেই জনপরিসরে মেয়েদের এই সসম্মান স্বাধিকারের দাবি পশ্চিমবঙ্গকে এক বিরল মর্যাদা এনে দিয়েছে। আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের সুযোগ এসেছে সমস্ত সুচেতন নাগরিকের সামনে। পশ্চিমবঙ্গের সমাজ যদি এই উদ্যোগকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে পারে, এক দিনের জন্য নয়, প্রতি দিনের জন্য নারীর স্বাধিকারকে স্বীকার করতে পারে, তবে ২০২৪ সালের ১৫ আগস্ট ক্যালেন্ডারের সীমা ছাড়িয়ে ঐতিহাসিক গন্তব্যের দিকে ধাবিত হবে।