অসামাজিক পরিবেশ আরজি কর জুড়ে! মদের বোতল এবং নানান নেশার দ্রব্যের ছড়াছড়ি, বহিরাগতদের মুক্তাঞ্চল!
এখনও বন্ধ হয়নি দালালি। টাকার বিনিময়ে বেড পাওয়া শুরু করে হাসপাতালি ভর্তি। সবই চলছে রমরমিয়ে। এককথায় বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। হাসপাতাল জুড়ে বহিরাগতদের দাপট। পড়ুয়াদের কাছে আতঙ্কের পরিবেশ। নার্সিংয়ের এক পড়ুয়ার কথায় ‘‘রাত হলেই আরজি কর চত্ত্বর ওদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়।’’ ঢুকতেই দেখা গেল আর জি কর হাসপাতালের স্টোর রুমের পাশে গাড়ি রাখার জায়গায় পড়ে আছে মদের বোতল।
সত্যিই হাসপাতাল বলে মনেই হবে না, যেন ‘বহিরাগতের’ মুক্তাঞ্চল! পর্যাপ্ত নিরাপত্তাকর্মী, আলোর ব্যবস্থার অভাব। অভিযোগ, অব্যবস্থার সুযোগে রাত হলেই চলে বহিরাগতদের অবাধ যাতায়াত। হাসপাতালেই মদ্যপানের আসর। প্রমাণ ছড়িয়ে হাসপাতাল চত্বরের সর্বত্র। কোথাও পড়ে রয়েছে একাধিক মদের বোতল, কোথাও বা অন্যান্য নেশার দ্রব্য। এমনই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের।
হাসপাতালেই এক চিকিৎসক পড়ুয়াকে খুন এবং ধর্ষণ-কাণ্ডে পরের দিনই গ্রেফতার অভিযুক্ত। ধৃতকে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রাথমিক ভাবে কিছু তথ্য হাতে পেয়েছেন তদন্তকারীরা। রাত ১১টার সময়ে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গিয়েছিল অভিযুক্তকে। ওই ফুটেজে হাসপাতালের চারতলায় এক রোগীকে সঙ্গে নিয়ে তাকে দেখা যায়। এর কিছু ক্ষণ পরে চারতলা থেকে বেরিয়ে হাসপাতালের ভিতরেই দীর্ঘ সময় ধরে মদ্যপান করে অভিযুক্ত। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, হাসপাতালের এমার্জেন্সি অর্থাৎ জরুরি ভবনের পিছনে কোনও এক জায়গায় বসে মদ্যপান করে গুনধর অপরাধী। রবিবারও হাসপাতাল চত্বরের পাশাপাশি, আশপাশে বহিরাগতদের বেলাগাম যাতায়াত ও মদের আসর বসার তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।
আর জি কর হাসপাতালে এমার্জেন্সি ভবনের পিছনে রয়েছে বহুতল স্টোর রুম এবং অ্যাকাডেমিক ভবন। এই দুই ভবনের এক দিকে রয়েছে অ্যানাটমি ভবন এবং উল্টো পাশে রয়েছে হস্টেল। এ ছাড়া আরও কয়েকটি বিভাগের ভবনও রয়েছে। এই অনেকটা এলাকা জুড়ে গোটা কয়েক আলো থাকলেও তা অপর্যাপ্ত। আর জি কর হাসপাতালের পড়ুয়াদের দাবি, এই অংশে সাধারণত চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনও কাজ না হওয়ায় রোগী বা তাঁদের আত্মীয়দের ভিড় থাকে না। দিনের বেলায় পড়ুয়াদের একটি অংশকে দেখা গেলেও সন্ধ্যা নামতেই তাঁরাও কেউ এখানে বিশেষ আসেন না। অভিযোগ, কেউ না আসার সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এই অংশে বহিরাগতদের মদের আসর বসে এবং বিভিন্ন অসামাজিক কাজ হয় বলেও অভিযোগ পড়ুয়াদেরই।
হাসপাতাল চত্বরের পিছনের অংশে বহুতল স্টোর রুমের নীচে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। সেখানে গোটা চারেক গাড়ি দাঁড়িয়ে। আশপাশের ফাঁকা জায়গাতেও আরও কয়েকটি গাড়ি দাঁড় করানো। স্টোর রুমের ওই চত্বরেই এ-দিক ও-দিক ছড়িয়ে রয়েছে মদের বোতল এবং প্লাস্টিকের গ্লাস। মদের বোতলের কোনওটি ভাঙা, আবার কোনওটি গোটা ফেলে রাখা রয়েছে। গোটা চত্বর জুড়ে পড়ে রয়েছে খাবারের প্যাকেটের সঙ্গে অন্যান্য নেশার সামগ্রী। হাসপাতাল জুড়ে বহিরাগতদের দাপটে নিজেদের আতঙ্কের কথা স্বীকার করলেন পড়ুয়ারাও। ‘‘রাত হলেই এই এলাকাটা ওদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়। সন্ধ্যা নামলেই কেউ আর ওই অঞ্চলে পা দেন না।’’ বহিরাগতেরা সংখ্যায় এতটাই বেশি থাকে যে চাইলেই জোর করে ঢুকে যায়। রাতে ওরা দল বেঁধে ঘোরে। আটকাতে গেলে কেউ বলে আমি স্থানীয়, কেউ কোনও রকম কথার উত্তর না দিয়েই ভিতরে ঢুকে যায়।’’ নিরাপত্তারক্ষীর কাতর স্বীকারোক্তী
আর জি করের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান চিকিৎসক সুদীপ্ত রায় এই অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘‘হাসপাতালকে কেন্দ্র করে একটা দালালচক্র সক্রিয় থাকে। কখনও রোগীর বাড়ির লোক সেজে, কখনও অ্যাম্বুল্যান্সের সহায়ক সেজে হাসপাতালে ঢোকার চেষ্টা করে। নিয়ন্ত্রণে আনতে এর আগেও একাধিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফের খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
আরজি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ পদত্যাগ করতে বাধ্যে হলেন। জুনিয়র চিকিৎসকদের লাগাতার আন্দোলনের চাপেই পদত্যাগ। নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে তিনি দাবি করেন, কারও চাপে নয়, স্বেচ্ছায় পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অধ্যক্ষের এই ইস্তফার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রী এবং জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবি, লিখিত আকারে পদত্যাগপত্র জমা দিতে হবে সন্দীপকে। মুখের কথায় পদত্যাগ মানতে নারাজ। ইস্তফা ঘোষণা করে সন্দীপ বলেন, ‘‘আমার ইস্তফাই ছাত্রছাত্রীদের কাম্য ছিল। সারা রাজ্যের এটাই কাম্য ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। আশা করব, এ বার ছাত্রছাত্রী এবং জুনিয়র চিকিৎসকেরা কাজে ফিরবেন। গত কয়েক দিনে বিভিন্ন মাধ্যমে আমি যে কটূক্তি সহ্য করেছি, আমার পরিবার, সন্তানেরা যা সহ্য করেছে, তাতে বাবা হিসাবে আমি লজ্জিত। তাই আমি পদত্যাগ করলাম। আশা করি আপনারা ভাল থাকবেন। আমার মুখে কথা বসিয়ে রাজনীতির খেলা চলছে। বিরুদ্ধ গোষ্ঠী এই ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক খেলায় নেমেছে। আমি কোনও দিন এ সব খেলা খেলিনি। আমি সরকারি কর্মচারী। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করব। আশা করব, ছাত্রছাত্রীরা শীগ্রই কাজে যোগ দেবেন।’’