তাঁর পাঞ্জাবিটা সাদাই রয়ে গেল, ধান্ধাবাজদের কাছে খুব অপ্রিয় ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
কোনও দিন রাজনীতির কথা বলেননি, খেলাপাগল ছিলেন, বললেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ৮০ বছর বয়সে জীবনাবসান প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। শোকস্তব্ধ বাংলার রাজনৈতিক মহল।
প্রয়াত রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি। তিনি জীবিত থাকতেই ভেঙে পড়েছে বামফ্রন্ট সরকারের লোহার দুর্গ। সিপিএমের শেষ মুখ্যমন্ত্রী। রাইটার্স ছেড়ে এলেও তিনি রেখে গেলেন বহু বিতর্ক। বামফ্রন্ট সরকারের শেষদিকে খুব প্রচলিত হয়েছিল একটা কথা -ব্র্যান্ড বুদ্ধ। কী সেই ব্র্যান্ড? কমিউনিস্ট পার্টির রেওয়াজে প্রায় অসম্ভব একটা জিনিস। পার্টির ঊর্ধ্বে উঠে কোনও একজন ব্র্যান্ড অন্তত তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব নয়। তবু সব দেশেই পার্টির এক একটা মুখ তো থাকেই। যেমন জ্যোতি বসু। বুদ্ধদেব তেমনই এক ব্র্যান্ড। কী সেই ব্র্যান্ড?
Saddened by the passing of Shri Buddhadeb Bhattacharjee, former CM of West Bengal. He was a political stalwart who served the state with commitment. My heartfelt condolences to his family and supporters. Om Shanti.
— Narendra Modi (@narendramodi) August 8, 2024
এই ব্র্যান্ড শিল্পপতিদের কাছে আতঙ্কের নয়। তিনি শিল্পবান্ধব, যিনি দেং শিয়াও পিংয়ের মতো পুঁজির রং দেখেন না। সিটুর কথায় কথায় বনধ ডাকা তাঁর ঘোর অপছন্দ। সবমিলিয়ে সিপিএমের নতুন যুগের স্বপ্ন বেচার সেলসম্যান। সিঙ্গুরে কার ভুলে ফ্রন্টের জাহাজ চড়ায় আটকে গিয়েছিল সে নিয়ে তক্কো ফুরোনোর নয়। সেই বিতর্কে বেঁচে থাকবেন বুদ্ধদেব। প্রমোদ দাশগুপ্তের বাছাই তরুণ ব্রিগেডের একজন বুদ্ধদেব। অন্যদের তুলনায় বরাবরই নেকনজরে। কাজ করেছেন ছাত্র-যুব ফ্রন্টে। তখন থেকেই তিনি আলাদা। তাঁর সুভাষ চক্রবর্তীর মতো সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল না, এক ডাকে ব্রিগেড ভরানোর ক্ষমতা ছিল না।
My deepest condolences on the passing away of Former Chief Minister of West Bengal, Shri Buddhadeb Bhattacharjee.
— Mallikarjun Kharge (@kharge) August 8, 2024
He served the people in a political career spanning more than five decades.
Our thoughts and prayers are with his family and comrades. pic.twitter.com/jsT0FbCNdl
তিনি আলাদা বাকিদের থেকে। নইলে চোরদের মন্ত্রিসভায় থাকবেন না বলে পার্টির যাবতীয় শৃঙ্খলা ভেঙে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেও তিনি ফিরে এসেছেন স্বমহিমায়। কোনও শাস্তি হয়নি। এমনকী পরের দিকে তাঁকে ‘ক্যাপিটালিজমের পোস্টার বয়: বলে ডাকা হলেও তিনি ছিলেন তাঁর জায়গাতে। তবে একটা কথা বলতেই হবে যা এখনকার সময়ে আরও জোর দিয়ে বলতে হবে। কেউ দুর্নীতির কোনও কালি লাগাতে পারেনি তাঁর ধবধবে সাদা পাঞ্জাবিতে। তাঁর সম্পর্কে অন্য অনেক কিছু নিয়ে কথা হতে পারে।কিন্তু দুর্নীতি নিয়ে একটাও নয়।
Shattering news about Buddha da. The news reached me as I was having a cataract removed. His dedication to the party, West Bengal, our shared ideals and also his ability to look ahead will always function as a lodestar. pic.twitter.com/khSfw2aaMS
— Sitaram Yechury (@SitaramYechury) August 8, 2024
“সততার শেষ কথা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আমি তো বলব সততার প্রতীক। আজ চলে যাচ্ছেন উনি, পরনের পাঞ্জাবিটা কিন্তু এখনও সফেদ। একটি দাগও নেই, ওঁর চরিত্রের মতো। ওঁর সন্তান সুচেতন কলেজের ভর্তি হওয়ার আগে বাকি ছাত্র-ছাত্রীদের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে আবেদন পত্র সংগ্রহ করেছিলেন। ভাবতে পারবে কেউ? জানতে পেরে বুদ্ধদাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম এই ঘটনার বিষয়ে। বলে উঠেছিলেন, ‘এতে অবাক হওয়ার কী আছে বিপ্লব? এটাই তো হওয়া উচিত।
I am deeply saddened to learn that former West Bengal Chief Minister; Shri Buddhadeb Bhattacharya has left for his heavenly abode.
— Suvendu Adhikari (@SuvenduWB) August 8, 2024
Condolences to his family members and admirers.
I pray that his soul finds eternal peace.
Om Shanti 🙏 pic.twitter.com/312uZBGFCV
একজন শিক্ষার্থী কলেজের ভর্তির আবেদন পত্র নিজের হাতেই তো তুলবে’। শুনুন, জোর গলায় বলছি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো এরকম শিক্ষিত, প্রখর সৌজন্যবোধ সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা আর আসবে না। নাটকের প্রতি ওঁর ভালবাসা সর্বজনবিদিত। যতটা সম্ভব শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতেন। তবে ঢাক পিটিয়ে নয়। তবে হ্যাঁ, ধান্ধাবাজ শিল্পীদের কাছে খুব অপ্রিয় ছিলেন! সহজভাবে সামলাতেন ‘ধান্ধাবাজ শিল্পীদের’। সরাসরি মুখের উপর চিৎকার করতেন না। মুখটা গম্ভীর করে স্রেফ এড়িয়ে যেতেন। ওই শিল্পীরাও বুঝে যেতেন এখানে সুবিধে হবে না। অবশ্য সেসব শিল্পী আজ বিরাট হাবভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা সুবিধেবাদী, পরবর্তী সময়ে সামান্য সুযোগ পেয়েই নিজেরটা গুছিয়ে নিয়েছেন”। ইতিহাস বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে মনে রাখবেন বলে মনে করেন বাম আদর্শে বিশ্বাসী বর্ষীয়ান অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “এমন একজন সৎ মানুষ যে এই সময়ের জন্য একেবারে বেমানান ছিলেন। তবু চেষ্টা করেছিলেন যাতে দেশের ভাল, বাংলার ভাল করা যায়”।
পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণে আমি অত্যন্ত শোকাহত। এই কঠিন সময়ে তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারজনের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা। ঈশ্বরের কাছে তাঁর বিদেহী আত্মার সদগতি প্রার্থনা করি।
— Dr. Sukanta Majumdar (@DrSukantaBJP) August 8, 2024
ওম শান্তি। pic.twitter.com/wDHz2ls07E
তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি থেকে শুরু করে সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জিও। শুধু তাই নয় বাম জমানার শেষ মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন জাতীয় রাজনীতির ব্যক্তিত্বরাও। বুদ্ধদেবের মৃত্যুতে টুইট করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লেখেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণে আমি গভীরভাবে শোকাহত। অত্যন্ত একনিষ্ঠ ভাবে উনি রাজ্যের সেবা করেছেন। ওঁর পরিবারকে সমবেদনা জানাই। ওম শান্তি’। প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষযাত্রা শুক্রবার। তাঁর দেহ শায়িত পিস ওয়ার্ল্ডে। পিস ওয়ার্ল্ডে যাওয়ার আগে বুদ্ধদেবের মরদেহের চক্ষু থেকে কর্নিয়া সংগ্রহের প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়েছে পরিকল্পনা মতো। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় সেখান থেকে দেহ বার করে শেষযাত্রা শুরু হবে রাজ্য বিধানসভার উদ্দেশে। সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বিধানসভায় মরদেহ থাকবে। সেখান থেকে বেলা ১২টা নাগাদ দেহ নিয়ে যাওয়া হবে সিপিএমের রাজ্য দফতর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে। সেখানেই মরদেহ শায়িত থাকবে বিকাল ৩টে পর্যন্ত। এরপর প্রয়াত বুদ্ধদেবের দেহ নিয়ে যাওয়া হবে দীনেশ মজুমদার ভবনে। সিপিএমের ছাত্র ও যুব সংগঠনের রাজ্য দফতরে। বুদ্ধদেব ছিলেন প্রাদেশিক যুব সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সভাপতি ছিলেন তাঁর বন্ধু এবং কমরেড দীনেশ মজুমদারের নামেই ভবনটি নামাঙ্কিত। পৌনে ৪টে পর্যন্ত বুদ্ধদেবের দেহ শায়িত থাকবে সেখানে। শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পরে মিছিল করে দেহ নিয়ে যাওয়া হবে শিয়ালদহের এনআরএস হাসপাতালে। সেখানেই বুদ্ধদেবের দেহ দান করা হবে ভবিষ্যতের চিকিৎসার গবেষণার কাজে। বুদ্ধদেবের পূর্বসূরি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর দেহও দান করা হয়েছিল। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল এসএসকেএম হাসপাতালে।
বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বুদ্ধদেবের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পাম অ্যাভিনিউয়ে পৌঁছেছিলেন। শুক্রবার সিপিএমের সর্বভারতীয় নেতারা কলকাতায় পৌঁছবেন। প্রকাশ কারাট, বৃন্দা কারাট, এমএ বেবিরা আসবেন দিল্লি থেকে। আগরতলা থেকে কলকাতায় পৌঁছবেন ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। পলিটব্যুরোর সদস্যদের মধ্যে তপন সেন এবং নীলোৎপল বসু কলকাতাতেই রয়েছেন। সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি শুক্রবার কলকাতায় আসছেন না। সীতারামের চোখে ছানির অস্ত্রোপচার হয়েছে। তিনি নিজে কলকাতায় আসার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলেও মহম্মদ সেলিমেরা তাঁকে সেই ঝুঁকি নিতে বারণ করেছেন। রাজ্য সিপিএমের তরফে সীতারামকে বলা হয়েছে, চলতি মাসেই বুদ্ধদেবের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে সীতারামকে আসতে হবে।
মুম্বই থেকে সৌরভ গাঙ্গুলী বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে খুবই ভাল সম্পর্ক ছিল। পুরোপুরি খেলাপাগল মানুষ ছিলেন। আমি তখন ভারতের অধিনায়ক। আমার সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে বিস্তর আলোচনা হত। আমি ছ’বছর ক্যাপ্টেন ছিলাম। যত বারই কথা হয়েছে, ক্রিকেট নিয়েই হয়েছে। শুধু সৌরভের ক্রিকেট বা সমকালীন ভারতীয় ক্রিকেট নয়, পঙ্কজ রায়ের ব্যাটিং নিয়েও আলোচনা হয়েছে।’’ পাশাপাশিই সৌরভ জানাচ্ছেন, এত বার কথা হলেও রাজনীতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কোনও দিন কোনও আলোচনা করেননি বুদ্ধদেব। তাঁর কথায়, ‘‘এত বার কথা হলেও কোনও দিন রাজনৈতিক ভাবে কিছু করতে বলেননি। রাজনীতি নিয়ে একটি কথাও বলেননি। এতটাই উদারতা ছিল ওঁর মধ্যে।’’