হাসিনার কাছে ‘গরিবের রক্তচোষা’ ইউনুস! শেখ মুজিবুরের ভক্ত নোবেল জয়ী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী
‘ইউনূসকে পদ্মায় ডোবানো উচিত’ সেতু তৈরির পরে আওয়ামী লীগের সভায় মন্তব্য করেছিলেন হাসিনা।
গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষকে জামানত ছাড়াই ঋণ দেওয়ার কাজটা করেছিলেন মুহাম্মদ ইউনূস। এই ব্যাঙ্ক স্থাপনের ভাবনার জন্যই তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। ২০২১ সালে হওয়া টোকিয়ো অলিম্পিক্সে বিশেষ সম্মান অলিম্পিক লরিয়াল পুরস্কার পান ইউনূস। গরিবের জন্য ব্যাঙ্ক চালানোর কৃতিত্বের জেরেই পরিচিত ইউনূস বাংলাদেশের সর্বেসর্বা। শেখ হাসিনার ইস্তফা এবং দেশত্যাগের পরেই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনোনীত। এক দিন শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ ইউনুসকে ‘গরিবের রক্তচোষা’ বলে অভিহিত করেছিল। জেলে বন্দি করতে চেয়েছিল।
হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরাগী ঢাকা বিশ্ববিদ্যলায়ের অর্থনীতির ছাত্র ইউনূস মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ‘বাংলাদেশ সিটিজেনস কমিটি’ অর্থাৎ বিসিসি গড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। বিসিসি-র প্রচার পুস্তিকার সম্পাদকও হন ইউনূস। মুজিবুরের মৃত্যুর পরে হাসিনার সঙ্গেও একটা সময় পর্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল তাঁর। ১৯৯৭ সালে ওয়াশিংটনে হওয়া মাইক্রোক্রেডিট অর্থাৎ ক্ষুদ্র ঋণ কনভেনশনে আমেরিকার তৎকালীন ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে হাসিনাকে যুগ্ম সভাপতিত্বের দায়িত্বে দিয়েছিলেন ইউনূসই। গরিব মানুষকে সুদের বিনিময়ে ঋণ দিতেই ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাঙ্ক। সেই কারণে ইউনূসকে ‘গরিবের রক্তচোষা’ বলেন হাসিনা। নানা মামলায় জড়িয়ে ব্যাঙ্কের প্রধান পদ থেকে নামিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, জেলেও পাঠাতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের ‘গর্বের’ পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে অন্তর্ঘাতের অভিযোগও তোলা হয় নোবেলজয়ীর বিরুদ্ধে।
ইউনূসের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৮ জুন। চট্টগ্রামের বাথুয়া গ্রামে জন্মানো ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। চট্টগ্রাম কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিয়েছিলন ইউনূস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৪ সালে মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষকতা ছেড়ে ইউনূস ফিরে আসেন বাংলাদেশে। তিন বছর আগে স্বাধীনতা পাওয়া মাতৃভূমির উন্নয়নে অবদান রাখতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন। ক্যাম্পাসের কাছাকাছি গ্রামের অলিগলি ঘুরে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেখার চেষ্টা করতেন। প্রথমে এক নারীকে ঋণ দিয়ে কাজ শুরু করেন। ৪২ জন নারীর একটি দলকে টাকা ধার দেওয়ার পর ‘মাইক্রোক্রেডিট’ গবেষণা প্রকল্প তৈরি করেন। ১৯৮৩ সালে জন্ম নেয় গ্রামীণ ব্যাঙ্ক। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করা মানুষের জন্য ইউনূসের এই ভাবনা তাঁকে একটা সময়ে ‘গরিবের ব্যাঙ্কার’ হিসাবে পরিচিতি দেয়। গোটা বিশ্বেই তাঁর প্রশংসা শুরু হয়। ২০০৬ সালে তার ঝুলিতে আসে নোবেল শান্তি পুরস্কার। মামলার চাপে, তখন আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রাক্তন মহাসচিব বান কি মুন এবং ১০০ জনেরও বেশি নোবেলজয়ী-সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ১৭০ জন খ্যাতনামী বিচারের নামে হয়রানি বন্ধ করতে হাসিনাকে চিঠিও লেখেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও হাসিনা সরকারের নিন্দা করে। সেই সময়ে অভিযোগ উঠেছিল, ইউনূসকে হাসিনার ঈর্ষার কারণ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। অনেকে বলতেন, হাসিনা নিজেই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তিতে আলোচনার জন্য এবং ২০১৭ সালে প্রতিবেশী মায়ানমারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার তাঁরও প্রাপ্য। আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। মিলেছে অনেক সম্মান। হাসিনার ‘চক্ষুশূল’ হয়ে ওঠার পরে জীবন অতটা আরামদায়ক ছিল না ইউনূসের। ইউনূস এবং তার টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি গ্রামীণ টেলিকমের আরও তিন কর্তাকে বাংলাদেশের শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে ছ’মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। জামিন পেয়ে যাওয়ায় জেলে যেতে না-হলেও জালিয়াতি, অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগে ২০০টিরও বেশি মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে ইউনূসকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব দেয়। এ বার মেনে নিলেও তখন সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ইউনূস। সেই বছরেই একটি রাজনৈতিক দল চালু করেছিলেন। কিন্তু মাস কয়েক যেতে না-যেতেই তিনি রাজনীতি থেকে দূরত্ব তৈরি করেন। প্রসঙ্গত, ইউনূসের সেই রাজনীতি করার কালে হাসিনা সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন। ইউনূস রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই ‘না’ বলে দেন। কিন্তু এ বার ‘হ্যাঁ’ বলেই, বাংলাদেশের এক কঠিন সময়ে প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন তিনিই।
এবার মুহাম্মদ ইউনূসই হচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান! ছাত্রজোটের দাবি মেনে নিলেন বাংলাদেশ ‘কর্তৃপক্ষ’
২০১২ সালে বিশ্বব্যাঙ্ক জানিয়ে দেয়, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় পদ্মা সেতু নির্মাণে তারা অর্থ দেবে না। ২০২২ সালে সরকারের অর্থেই সেই সেতু নির্মাণ হয়। পরে আওয়ামী লীগের পক্ষে অভিযোগ ছিল, প্রতিশোধ নিতেই বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণ আটকে দিতে ইউনূসের ভূমিকা রয়েছে। প্রতিশোধের কারণ, ইউনূসের বয়স হয়েছে বলে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক থেকে জোর করেই বার করে দিয়েছিল হাসিনার সরকার। সেতু তৈরির পরে আওয়ামী লীগের একটি সভায় হাসিনা মন্তব্য করেছিলেন ‘ইউনূসকে পদ্মায় ডোবানো উচিত’।২০১২ সালে ইউনূস উগান্ডায় সমকামীদের বিচারের সমালোচনা করে অন্য তিন নোবেলজয়ীর সঙ্গে একটি যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। দেশে এর জন্যও সমালোচনা সইতে হয়েছে ইউনূসকে। ‘সমকামিতাকে সমর্থন করায় ধর্মত্যাগী’ হিসাবে নিন্দা করে গণ-সমাবেশের আয়োজন করেছিল বাংলাদেশের সরকার পরিচালিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
অনেক কঠিন সময়ে সুযোগ থাকা সত্বেও বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাননি নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনুস। ইউনূস বলেছিলেন, ‘‘আমি জেলের সাজা এড়াতে চাই বলেই দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারি না। যে মুহূর্তে আমি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মনে হয়েছে, শিকড় ছিঁড়ে যাবে।’’