হতাশ মানু , ফাইনাল রাউন্ডে আমি একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম
পদকের হ্যাটট্রিক হাতছাড়া। রেকর্ডবুকে নাম লেখানোর একধাপ দূরে থেমে গেলেন। একটুর জন্য ফস্কে গেল তৃতীয় ব্রোঞ্জ। ২৫ মিটার পিস্তল ফাইনালে চতুর্থ স্থানে শেষ করলেন মানু ভাকের। শুরুটা ভাল করেছিলেন। মোট নয় সিরিজের মধ্যে মাঝেরগুলোতে ভাল পজিশনে ছিলেন ভারতীয় শুটার। একটা সময় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসেন। মনে হয়েছিল তৃতীয় পদক নিশ্চিত। কিন্তু তীরে এসে তরী ডুবল। অষ্টম সিরিজে হাঙ্গেরির ভেরোনিকা মেজরের সঙ্গে শুট অফে হার মানুর। দুটো শট মিস করেন ভারতের জোড়া ব্রোঞ্জ জয়ী। স্কোর ৩-৪। ঐতিহাসিক হ্যাটট্রিক মিস করায় স্বাভাবিকভাবেই খুবই হতাশ মানু। যা তাঁর চোখে-মুখে, শরীরীভাষাতেই স্পষ্ট। যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। জোড়া ব্রোঞ্জ জয়ের সাফল্য ভুলে তৃতীয় পদক হাতছাড়া হওয়ার হতাশা গ্রাস করে নেয় ২২ বছরের ভারতীয় শুটারকে। আর মাত্র একটা রাউন্ড পেরোতে পারলেই নিশ্চিত ব্রোঞ্জ। ফাইনাল রাউন্ডে দুটো শট মিস হল কেন? মানু বলেন, ‘ফাইনাল রাউন্ডে আমি একটু নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম। তারই প্রভাব পড়েছে। খুবই খারাপ লাগছে। মেনে নিতে পারছি না। কী বলব বুঝতেও পারছি না।’
অলিম্পিকের ভেন্যু থেকে লাইভ ইন্টারভিউ দেওয়ার সময়ই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন মানু। ঠিক মতো কথাও বলতে পারছিলেন না শুরুতে। চোখের কোণে জল চিকচিক করছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, যেকোনও সময় কেঁদে ফেলবেন। কিন্তু অনেক কষ্টে ইন্টারভিউ চলাকালীন চোখের জল আটকালেন। তবে আবেগে বুজে আসে গলা। তারমধ্যেই মানু বললেন, ‘দুটো পদক জেতায় খুশি। তবে এই মুহূর্তে আমি খুব একটা ভাল জায়গায় নেই।’ গত কয়েকদিন ধরে মানুতে মজে গোটা দেশ। তাঁকে নিয়ে যে হইহুল্লোড়, উন্মাদনা হচ্ছে, তার প্রভাব কি খেলায় পড়ল? মানু বলেন, ‘আমি সোশ্যাল মিডিয়া, ফোন থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলাম। সুতরাং আমাকে নিয়ে কী চলছে আমি জানি না এবং সেই নিয়ে ভাবিনি।’ প্যারিসের মঞ্চ থেকেই পরবর্তী লক্ষ্য সেট করে ফেললেন ভারতীয় শুটার। একইসঙ্গে এই সাফল্যের জন্য ধন্যবাদ জানান তাঁর টিম, পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবদের। মানু বলেন, ‘ম্যাচ শেষ হওয়া মাত্রই পরের লক্ষ্য স্থির করে ফেলি। এখানে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। পরের অলিম্পিকে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আরও ভাল করতে হবে। আমার এই সাফল্যের অন্তরালে অনেকের কঠোর পরিশ্রম আছে। আমাকে পোডিয়াম পর্যন্ত পৌঁছে দিতে, ভারতকে পদক এনে দেওয়ার জন্য আমার পুরো টিম প্রাণ লড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রক, মোদি জিও সাহায্য করেছে। আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা পাশে থেকেছে। আশা করছি পরের বার আরও ভাল করতে পারব।’
নিজের মাকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানান জোড়া ব্রোঞ্জ জয়ী। মানু বলেন, ‘তোমার যাবতীয় আত্মত্যাগের জন্য ধন্যবাদ। তোমার সাপোর্টের জন্যই আমি সকলের ছায়া থেকে বেরিয়ে এই জায়গায় পৌঁছতে পেরেছি। মা, আমি তোমাকে ভালবাসি। সুস্থ থাকো এবং দীর্ঘজীবী হও। আরও যতগুলো বছর, যতগুলো দিন সম্ভব আমার সঙ্গে থাকো।’ মেয়ের এই কথা শুনে আবেগে ভেসে যান মানুর মা। নিজের বাড়িতে টিভির পর্দায় মেয়ের হার দেখার পর কান্না চেপে রাখতে পারেননি। কোনওরকমে নিজেকে সামলে চোখ মুছে মানুর মা বলেন, ‘তুমি ভাল খেলেছ। শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছো। তুমি আনন্দে থাকো। খুশিতে থাকো। তোমার জন্য আমি গর্বিত। প্রত্যেক বাড়িতে যেন এমন মেয়ে জন্মায়।’ প্যারিসকে বিদায় জানানো সময় হয়ে গিয়েছে মানুর। তবে তার আগে তিনি কী করবেন? মানু বলেন, ‘সবার আগে আমি লাঞ্চ খাবো। এতদিন সেই সুযোগ পাইনি। ব্রেকফাস্টের পর আর সারাদিন কিছু খেতাম না। একেবারে রাতে ডিনার খেতাম। সেই পরিশ্রম কাজে লাগল না।’ পদকের হ্যাটট্রিক না হলেও ইতিহাসে নাম উঠে গিয়েছে মানু ভাকেরের। প্রথম ভারতীয় হিসেবে একই অলিম্পিকে জোড়া পদকের পাশাপাশি তিনটে শুটিং ফাইনালের যোগ্যতা অর্জনের রেকর্ড করেন।
একই অলিম্পিক্সে দু’টি পদক। তৃতীয় পদকের কাছে গিয়েও থেমে যেতে হয়েছে। প্রথমে শুটিং নয়। মনু ভাকের ছোটবেলায় অন্য পাঁচটি খেলাকে ভালবেসেছিলেন। বিভিন্ন খেলায় জাতীয় গেমসে পদকও জিতেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বেছে নেন শুটিংকে। কারণ তাঁর চোখে চোট লেগেছিল। সেই চোট না লাগলে হয়তো অন্য কোনও খেলায় অলিম্পিক্সে ভারতের জার্সি পরতেন মনু। ১৪ বছর বয়সে শুটিং শুরু করেন মনু। তার আগে বক্সিং, টেনিস, স্কেটিং, ভলিবল, মার্শাল আর্টসের মতো খেলায় যুক্ত ছিলেন। জাতীয় গেমসে বক্সিং, টেনিস এবং স্কেটিংয়ে পদকও আছে মনুর। স্কুলে ভলিবল খেলতে গিয়ে চোখে চোট লাগে মনুর। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন খেলায় পারদর্শী হলেও তিনি বাধ্য হয়েছিলেন এমন খেলা বেছে নিতে যেখানে শারীরিক সংঘর্ষ নেই। তাই বক্সিং, টেনিস, স্কেটিং, ভলিবল ছেড়ে মনু বেছে নেন শুটিং। চোখে চোট লাগলেও লক্ষ্য স্থির মনুর। দ্রুত উন্নতি করেন শুটিংয়ে। মনুর বয়স এখন ২২ বছর। মাত্র আট বছর শুটিং করেই দেশকে অলিম্পিক্স পদক এনে দিলেন। ২০০২ সালে হরিয়ানার ঝাঁঝরে জন্ম মনুর। বাবা রামকিশন ভাকের ছিলেন মার্চেন্ট নেভির ইঞ্জিনিয়র। মা সুমেধা একটি স্কুলের প্রিন্সিপল। সেই স্কুলেই পড়াশোনা করেছেন মনু। ২০১৬ সালে প্রথম বার বন্দুক হাতে নেন। সেই বন্দুকটার দাম ছিল এক লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ২৫ কিলোমিটার দূরে একটি শুটিং রেঞ্জে অনুশীলন করতে যেতেন মনু। প্রতি দিন পাঁচ ঘণ্টা করে চলত অনুশীলন।
১২৪ বছরের তফাৎ। একই অলিম্পিকের মঞ্চে জোড়া পদক। এখনও পর্যন্ত ইতিহাসে দুই ভারতীয়। ১৯০০ সালে নরম্যান প্রিচার্ড এবং ২০২৪ সালে পেলেন মানু ভাকের। ১২৪ বছরের তফাতে দুটি অলিম্পিকই অনুষ্ঠিত হয়েছে প্যারিসে। ১৯০০ সালের প্যারিস অলিম্পিকে ২০০ মিটার স্প্রিন্ট এবং ২০০ মিটার হার্ডলে রূপো জিতেছিলেন প্রিচার্ড। তখন ভারত ছিল ব্রিটিশদের দখলে। ভারতের হয়ে পদক জিতলেও আদতে নরম্যান ছিলেন ব্রিটিশ। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একই অলিম্পিকে কোনো অ্যাথলিট জোড়া পদক জিতেছেন এমন সৌভাগ্য হয়নি। ১০ মিটার এয়ার পিস্তলের মিক্সড টিম ইভেন্ট এবং সিঙ্গল ইভেন্ট দুটি ম্যাচেই ব্রোঞ্জ জিতে ইতিহাস গড়লেন হরিয়ানার শুটার মানু ভাকের।
ঝুলিতে দুটো অলিম্পিক্স খেতাব। তাও আবার একই অলিম্পিক্সে। টোকিও অলিম্পিকে যোগ্যতা অর্জন করতে না পারার কারণ প্রতিযোগিতা চলাকালীন পিস্তল কাজ না করায় তিনি ছিটকে যান। ভেবেছিলেন শুটিং ছেড়ে দেবেন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্যারিস অলিম্পিকে দেশের হয়ে প্রথম পদক আনলেন। টোকিওর হতাশা থেকেই জেদ বেড়ে গিয়েছিল। প্যারিস অলিম্পিক্সে ব্যক্তিগত ও মিক্সড টিম ইভেন্টে নেমেই ব্রোঞ্জ ঝুলিতে পুরে নিয়েছেন। ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জেতেন মনু। নিজের ব্র্যান্ড ভ্যালু কয়েকগুন বাড়িয়ে নিলেন মনু। বিজ্ঞাপনের মুখ করতে প্রায় ৪০ টির বেশী সংস্থার মনুকে নিয়ে টানাটানি। আগেও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মুখ ছিলেন মনু। বিজ্ঞাপন পিছু ২০ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা নিতেন। প্যারিস পদক জয়ের পর বিজ্ঞাপন পিছু প্রায় দেড় কোটি টাকা নাকি নিচ্ছেন এখন মনু। মনুর পি আর টিম ও আইওএস স্পোর্টস অ্যান্ড এনটারটেইনমেন্ট সংস্থার সিইও ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর নীরব তোমারের কথায়, ”গত কয়েকদিনে মনু যেভাবে অলিম্পিক্সে সাফল্য পেয়েছে, তার পর প্রায় ৪০টি বিজ্ঞাপনের প্রস্তাব এসেছে। তবে আমরা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির দিকেই নজর দিচ্ছি। কয়েকটির সঙ্গে চুক্তিও হয়ে গিয়েছে।”
পিভি সিন্ধু ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিক এবং ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকে পদক জিতেছিলেন।সুশীল কুমার ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিক এবং ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকে পদক জিতেছিলেন। একই অলিম্পিকে একই অ্যাথলিট জোড়া পদক পেলেন এমন ঘটনা ঘটল ১২৪ বছর পর। তাও আবার প্যারিসের মাটিতেই। হরিয়ানার তরুণী। ১২ বছরের খরা কাটলেন। দুই দশক পর অলিম্পিকে শুটিং ইভেন্টে পদক ভারতের। রবিবার ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ফাইনালে ব্রোঞ্জ জিতলেন মনু ভাকের। ভারতের প্রথম মহিলা শুটার। মনু অলিম্পিকে পদক জিতলেন। কোয়ালিফিকেশন রাউন্ডে তৃতীয় হয়ে ফাইনালে উঠেছিলেন মনু। প্রথম থেকেই পদকের দৌড়ে থাকা মনুকে প্রথম কয়েকটা রাউন্ডের পর প্রথম তিন থেকে একবারের জন্যও সরানো যায়নি। সামনে দুই কোরিয়ান প্রতিযোগী। তিন প্রতিযোগীর মধ্যে পয়েন্টের তফাৎ ছিল একেবারেই সামান্য। দ্বিতীয় স্থানে থেকে রুপোর দৌড়ে ছিলেন মনু। শেষ এলিমিনেশন রাউন্ডে ১০.৩ পয়েন্ট নেন হরিয়ানার শুটার। কোরিয়ান প্রতিযোগী ১০.৫ পয়েন্ট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসেন এবং তৃতীয় স্থান অর্জন করে ব্রোঞ্জ নিশ্চিত করেন মনু। টোকিও অলিম্পিকে যোগ্যতা অর্জন করতে না পারার কারণ প্রতিযোগিতা চলাকালীন পিস্তল কাজ না করায় তিনি ছিটকে যান। ভেবেছিলেন শুটিং ছেড়ে দেবেন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্যারিস অলিম্পিকে দেশের হয়ে প্রথম পদক আনলেন। ১২ বছর আগে অলিম্পিকে শেষ শুটিংয়ে পদক এসেছিল ভারতের। ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিক্সে শেষ বার গগন নারাং পদক দিয়েছিলেন ভারতকে। তিনিও ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিলেন। তার পর দু’টি অলিম্পিক্সে শুটিং থেকে কোনও পদক আসেনি। সেই খরা কাটালেন মনু। হরিয়ানার তরুণীও সেই ব্রোঞ্জ পদক পেলেন। মনু প্রথম মহিলা শুটার যিনি ভারতের হয়ে শুটিংয়ে পদক আনলেন। শেষ পর্যন্ত স্নায়ুর চাপ সামলে দ্বিতীয় স্টেজে ভাল পারফর্ম করে দেশকে পদক দিলেন হরিয়ানার ২২ বছরের শুটার। তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সমাজমাধ্যমে অভিনন্দন জানিয়েছেন অলিম্পিক্সের সোনাজয়ী ভারতের এক মাত্র শুটার অভিনব বিন্দ্রাও।
শুটিংয়ে ১২ বছরের খরা কাটিয় মনু জানিয়েছেন, এই পদক প্রাপ্য ছিল ভারতের। মনু বলেন, “ভারত অনেক দিন ধরে এই পদকের অপেক্ষা করেছিল। আমার হাত দিয়ে সেটা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করব আরও বেশি পদক জেতার। দলের সকলেই খুব পরিশ্রম করেছে। আমিও খুব পরিশ্রম করেছি। শেষ শটেও শরীরের সব শক্তি দিয়ে লড়ার চেষ্টা করেছি। পরের বার আরও ভাল করার চেষ্টা করব।” গীতায় কৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছিলেন, নিজের কর্ম করতে। সেই উপদেশ মেনে চলেন মনুও। তিনি বলেন, “আমি গীতা পড়েছি। ফাইনালের একেবারে শেষ মুহূর্তে সেই কথাই ভাবছিলাম। শুধু নিজের কাজটা করেছি। বাকিটা নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়েছি। গীতায় অর্জুন কৃষ্ণকে বলেছিলেন, ‘কর্ম করে যাও, ফলের আশা কোরো না।’ সেটাই করার চেষ্টা করেছি।”