হাতে হাত ধরে মানবসেতুর ভিডিয়ো প্রকাশ্যে! ওয়েনাড়ের দুর্গতদের ও শিশুদের কোলে তুলে উদ্ধার করছে সেনা
প্রবল স্রোতে বইছে নদী। তার উপরে দু’দিকের স্থলভাগে দড়ি টাঙিয়ে কোনও রকমে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মানুষকে। মাঝে সেনা জওয়ানেরা দু’হাত বিছিয়ে দড়ি ধরে সংযোগ রক্ষার চেষ্টা করছেন। শিশুদের কোলে তুলে নিচ্ছেন জওয়ানেরা। নিরাপদ স্থানে তাঁদের কোলে করেই পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, ওয়েনাড়ের চূড়ামালা গ্রামে মানবসেতু তৈরি করেছিলেন জওয়ানেরা। ওই গ্রামে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন ১২২ ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়ন মাদ্রাসের জওয়ানেরা। ১২ জন জওয়ান মিলে মানবসেতু তৈরি করেন। আর বালির স্তূপ ঘেঁটে ঘেঁটে প্রাণের খোঁজ চালাচ্ছেন উদ্ধারকারীরা। চার ঘণ্টায় চারটি ধসে চার চারটি গ্রাম নিশ্চিহ্ন। পাহাড়ের ঢালে থাকা সুদৃশ্য চুরালমালা, মুন্ডাক্কাই, অট্টামালা এবং নুলপুঝা গ্রাম। দৃশ্য একেবারে বদল। নেই সবুজ বনানী, নেই কফি বাগান, নেই পাহাড়ের কোলে সুদৃশ্য বাড়িগুলি! একেবারে ধুয়েমুছে সাফ। ওয়েনাড়ের ধসে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মুন্ডাক্কাই এবং চুরালমালা। ছোট একটা সাজানো গোছানো গ্রাম। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু চুরালমালা। দৃষ্টিনন্দন সূচিপাড়া জলপ্রপাত ছাড়াও রয়েছে ভেলোলিপাড়া এবং সীতা হ্রদ। হ্রদ এবং পাহাড়ের কোলেই অবস্থিত গ্রামটি।
ওয়েনাড় জেলার উপরিভাগে কালপেট্টায় প্রথমে ২০০ মিলমিটার বৃষ্টিতে ধস নামে চুরালমালা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের গ্রাম মুন্ডাক্কাইয়ে। ধসের উৎস এখান থেকেই। গভীর রাতে হড়পা বানের সঙ্গে ‘গোটা পাহাড়টাই’ যেন নেমে আসে নীচের দিকে। মুষলধারে বৃষ্টি কালপেট্টা, চুরালমালা, মুন্ডাক্কাই-সহ ওড়েনাড়ের বেশ কিছু জায়গায়। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন পাহাড়ি গ্রামগুলোতে নিবিড় নিস্তব্ধতা ভেঙে মধ্যরাত থেকে ভোরের মধ্যে আছড়ে পড়ল প্রকৃতির রোষ। বালি-কাদার স্তূপের সঙ্গে বয়ে নিয়ে চালিয়ার নদীর মধ্যে দিয়ে নীচের দিকে দুরন্ত গতিতে নামছিল ধস। পুরো মুন্ডাক্কাইকে নিশ্চিহ্ন করে চুরালমালাকে লন্ডভন্ড করে সেই ধস এগিয়ে চলেছিল দু’টি গ্রাম গ্রাস করতে। অট্টামালা এবং নুলপুঝাতে গিয়ে আছড়ে পড়ে সেই ধস। চারটি গ্রাম মিলিয়ে ২২ হাজার লোকের বাস। ওয়েনাড়ের মানচিত্র থেকে প্রায় মুছে গিয়েছে মুন্ডাক্কাই। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এই চার গ্রামে মূলত চা এবং কফি শ্রমিকদেরই বাস। গভীর রাতে ধস নামায় কেউ পালানোর বা নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার সুযোগটুকুও না পেয়ে কাদা, বালি আর পাথরের নীচেই চাপা পড়ে গিয়েছেন। গ্রাম থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে মৃতদেহ উদ্ধার হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত এই ধসের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১৫১ জনের। দুশোরও বেশি মানুষ নিখোঁজ।
“গত ২৩ জুলাই অর্থাৎ দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ আগে কেরল সরকারকে সতর্ক করেছিল কেন্দ্র। তার পর ২৪ এবং ২৫ জুলাই আরও দুটি সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। গত ২৬ জুলাই আরও একবার প্রবল বৃষ্টিপাত এবং ভূমিধসের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল। এমনকী এনডিআরএফের ৯টি দলও পাঠানো হয়েছিল কেরলে।” রাজ্যসভায় বিবৃতি দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আক্ষেপ, “২০১৪ সাল থেকে আগাম সতর্কবার্তার বন্দোবস্ত করার জন্য ২০০০ কোটি টাকা খরচ করে কেন্দ্র। সেই মতো কেরল সরকারকে সতর্কও করা হয়েছিল। কিন্তু কেরল সরকার কোনও মানুষকেই নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যায়নি। যদি নাগরিকদের নিরাপদে সরানো হত, তাহলে এত মানুষের প্রাণ যেত না।” কেরলের বাম সরকারকে রীতিমতো কাঠগড়ায় তুলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এই ইস্যুতে আমরা রাজনীতি করতে চাই না। এখন সময়টা কেরল সরকারের পাশে দাঁড়ানোর।”
https://twitter.com/prodefgau/status/1818549666897707323/photo/4
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দাবি খারিজ কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের। বিজয়ন স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘‘ওয়েনাড়ে ধসের সম্ভাবনা নিয়ে কেন্দ্রের তরফে কেরলকে কোনও সতর্কবার্তা পাঠানো হয়নি। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতর (আইএমডি)-এর তরফে ভূমিধসের কোনও পূর্বাভাস দেওয়া হয়নি। শুধু ওয়েনাড় জেলায় বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা সংক্রান্ত কমলা সতর্কতা। কার্যক্ষেত্রে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৫০০ মিলিমিটারের বেশি। যা পূর্বাভাসের তুলনায় অনেক বেশি।’’
১২ জন জওয়ান মিলে মানবসেতু। ওয়েনাড়ের চূড়ামালা গ্রামে মানবসেতু তৈরি করেছিলেন জওয়ানেরা। ওই গ্রামে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন ১২২ ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়ন মাদ্রাসের জওয়ানেরা। ১২ জন জওয়ান মিলে মানবসেতু তৈরি করেছিলেন ওই গ্রামে। ভূমিধসের কারণে কেরলের বাকি অংশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ওয়েনাড়ের কয়েকটি গ্রাম। যোগাযোগের কোনও উপায় নেই। যাতায়াতের রাস্তাও ভেসে গিয়েছে। নদী বইতে শুরু করেছে ভিন্ন পথে। এই পরিস্থিতিত ওয়েনাড়ে দিনরাত এক করে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন জওয়ানেরা। জাতীয় এবং রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীও উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছে। ওয়েনাড়ে বৃষ্টি চলছে। প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়েছে। উদ্ধারকাজ যত এগোচ্ছে, বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। বহু মানুষ এখনও নিখোঁজ।