এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো…
দোল উৎসবের আবহে মিষ্টিমুখ, খাওয়াদাওয়া না করলে আনন্দই মাটি! ওজন কমাতে বাদ চিনি, ভাজাভুজি। লাড্ডু, চাট খেয়েও রঙের উৎসব পালন। ক্যাফিন ছাড়া কফি! মিষ্টি, ভাজাভুজি, চাট বাদ। মোতিচুর, বেসনের লাড্ডু, চিনি ছাড়া খেজুর, বিভিন্ন রকম ড্রাই ফ্রুটস কাজু, পেস্তা, কাঠবাদাম এবং রাগি দিয়ে লাড্ডু। পাপড়ি বা দই চাট। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বা আলুর চিপ্স। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের জন্য আলু লম্বা করে কেটে সেদ্ধ এয়ারফ্রায়ারে দিয়ে বেক করে তৈরি স্বাস্থ্যকর চিপ্স। ফ্র্যাঙ্কি দিয়ে রাগির রুটি। রুটির ভিতরে রাখতাম গ্রিল করা রকমারি সব্জি। আমিষ খেলে সব্জির বদলে মুরগির মাংস সস্ হিসাবে ব্যবহার জল ঝরানো টক দই।
আজকাল সকলেই স্বাস্থ্য সচেতন। খোঁজ করেন ভেষজ দোল কোথায় খেলা হবে। ধনেপাতা, গাঁদাফুল, পালং শাখ, বিট-গাজর পিষে তৈরি আবির। দোলের আগে সুগন্ধি গোলাপি আবিরের দাম বাজারের সাধারণ আবিরের তুলনায় বেশি হয়। ধুর আমৃতবাণী বেলা গেল সহজেই, মরমে উঠিল বাজি বসন্ত এসে গেছে। এলো রে দেল দোল উৎসব। মাতবে গোটা দেশ। বসন্তের ছোঁয়ায় চারিপাশের গাছে রং বেরঙের ফুল। দোল উৎসবে রংবেরঙের আবির খেলা। দোল উৎসবের আবির একটু ভেষজ হওয়ার দিকেই নজর বেশী। ১৪মার্চ দোল ও ১৫মার্চ হোলি। আবিরের বিষাক্ত কেমিক্যাল আস্বাদ এড়িয়ে যেতে মরিয়া প্রত্যেকেই। আপাতত ভেষজ আবিরের জুড়ি মেলা ভার। আগে ভেষজ আবিরের চাহিদা এত বিপুল পরিমাণে ছিল না। আবিরে মেশানো কেমিক্যাল ও সিন্থেটিকের কারণে এলার্জি-সহ নানা সমস্যা। বাড়ছে ভেষজ আবিরের চাহিদা।
প্রাকৃতিক সুগন্ধির সঙ্গে ধনেপাতা, পালং শাখ গাঁদা, অপরাজিতা, কাঁচা হলুদ, জবা-সহ একাধিক ফুল ও গাছের ছাল ও পাতা দিয়ে তৈরী আবির। ৮ থেকে ১০ দিন ধরে মেহনত করে প্রস্তুত ভেষজ আবির স্বাস্থ্যসম্মত এবং সুগন্ধি। বাজারে চাহিদাও তুঙ্গে। কলকাতার কেমিক্যাল যুক্ত বিভিন্ন রকমের আবিরের বদলে ভেষজ আবিরের ব্যবহার বেড়েছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা দোলের আগে প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান দিয়ে ভেষজ আবির তৈরি করেন। বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করে বাড়তি লক্ষ্মীলাভ। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলা দলকে ভেষজ আবির তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিশেষ কিছু ফুল, ফল, পাতা ব্যবহার করে আবির তারী করা হয়। গাঁদা ফুল, কাঁচা হলুদ, বিট, অপরাজিতা, পলাশ ও সিঁদুরে ফল সহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহারে ভেষজ আবির। হালকা রোদে শুকিয়ে নেওয়ার পর প্যাকেটজাত। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভেষজ আবির ব্যবহারে ক্ষতির আশঙ্কা না থাকার পাশাপাশি পরিবেশের ক্ষতি হয় না। চাহিদা মতো যোগান দিতে হিমসিম। কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রের লেভেল সাঁটানো থাকে ভেষজ আবিরে। এক থেকে একশো কেজি পর্যন্ত প্যাকেট। হলুদ ও গোলাপী সহ নানান রঙের আবির। সিঁদুরে ফলের মিশ্রনে তৈরী গেরুয়া আবির। রঙ খেলার প্রতি বেশি আগ্রহ থাকলেও প্রত্যেকেই কম-বেশি স্বাস্থ্য সচেতন৷ সুগন্ধি আবির সকলেরই পছন্দ। ভেষজ আবির ক্রেতাদের ঝোঁক বিভিন্ন রঙের আবিরের থেকে সবুজ আবিরের চাহিদা বেশি। সবুজ আবির তৈরি বাঙালির প্রিয় পালং শাক ও ধনেপাতা দিয়ে। পালং ও ধনে ফ্লেভারের সবুজ আবির কেনার আগে শুঁকে দেখতে চান ক্রেতারা। সবুজের পাশাপশি গেরুয়া, হলুদ, সবুজ, লাল রঙের আবিরের চাহিদা বেশি। রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্যোগে কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের মহিলাদের পরিশ্রমে সুগন্ধি আবির বাজারজাত। গেরুয়া রঙের আবিরের জন্য কর্নফ্লাওয়ার পাউডারের সঙ্গে সিঁদুর ফল থেকে নির্যাস বের করে মেশানো হয়। লাল রঙের আবিরে জবা ফুলের পাপড়ির গুঁড়ো মিশিয়ে দেওয়া হয়। লাল ও গোলাপি রঙের জন্য বিট রুটের নির্যাসের সঙ্গে কর্নফ্লাওয়ার পাউডারের মিশ্রণ। হলুদ রঙের আবিরের জন্য গাঁদা ফুলের পাপড়ির গুঁড়ো। কমলালেবুর খোসা মেশানো কমলা রঙের আবির। সুগন্ধির জন্য প্রত্যেক আবিরেই রজনীগন্ধা ফুলের এসেন্স ব্যবহার। পালং ও ধনে পাতার নির্যাস সাদা অ্যারারুটের সঙ্গে মিশিয়ে তৈরী সবুজ আবির। পালং ও ধনে পাতার নির্যাসে তৈরী দু’টি ফ্লেভারের সবুজ আবিরের। প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি রাসায়নিকহীন, দূষণহীন ভেষজ আবির মেশিনের বদলে সম্পূর্ণ হাতে তৈরি। সময় সাপেক্ষ ও কায়িক পরিশ্রমে তৈরী ভেষজ আবির শিশু থেকে প্রবীণ ব্যক্তিরাও অনায়াসে ব্যবহারে কোন রকম শারীরিক সমস্যা হয় না। প্রাকৃতিক উপায় তৈরি আবির বড় প্রতিবন্ধকতা দামে।কেননা যেখানে খোলা বাজারে ১০০ গ্রাম আবিরের দাম অন্তত ১৫ থেকে ২০ টাকা। সেখানে এই ভেষজ আবিরের দাম পড়ছে ৪০ টাকা। এই আবহে বাজারজাত না হলেও জেলা গ্রামোন্নয়ন দপ্তর ভেষজ আবির বিক্রির জন্য মহিলাদের আর্থিকভাবে উৎসাহিত করছেন।দলের প্রস্তুত করা আবির যাতে অনলাইনে বিক্রি করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চোপড়ার,সোনাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ধন্দুগছ এলাকায় শক্তি সংঘ ও সোনার তরী দলের মহিলারা এবার চোপড়া কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে অনেকদিন আগেই প্রশিক্ষণ নিয়ে যৌথভাবে আবির তৈরিতে নেমে পড়েছেন।
বাবা-কাকারা দোলের দিন পুরনো পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে পকেটে আবিরের প্যাকেট নিয়ে রং খেলতেন। বন্ধুর বাড়ি অথবা ক্লাব বা আড্ডাস্থল। দুপুর পর্যন্ত মিষ্টি-চা সহযোগে মধুরেণ সমাপয়েৎ। বিকেলে গন্তব্য আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। বাবা মায়েরা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গুরুজনের পায়ে ফাগ দিয়ে প্রণাম করার পরে মঠ-ফুটকড়াইয়ের সঙ্গে ঘুগনি, আলুর দম রসনায়। সাংসারিক মানুষের দোলে রাতে ‘পিকনিক’এর মেনু মাংস-ভাত। বেকার যুবক এবং তথাকথিত ‘বখে যাওয়া’ ছেলে-ছোকরাদের দোলে থাকত বাঁদুরে রং, কাদাজল, বাড়ির চৌবাচ্চায় রং গুলে বন্ধুদের চুবিয়ে দেওয়ার মতো দুষ্টুমি। মাত্রা ছাড়ালে রাগ-অভিমান। তবু সবাই সবাইকে ছুঁয়ে থাকা। টলে গেলে মাথা এলিয়ে ইয়ারদোস্তের কাঁধে রাখা স্পর্শসুখ। আধুনিকতার ছোঁয়ায় দোলের স্পর্শ স্মার্টফোনে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-পরিজন কর্মসূত্রে বাইরের দুনিয়া জুড়ে। বিজয়ার প্রণাম, স্মার্টফোনের টাচস্ক্রিনে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে ভাইফোঁটা পালন আর দোলও পালন ভার্চুয়াল মাধ্যমে! বহু বীরু আর বাসন্তী দোলের দিন দুনিয়ার দু’প্রান্তে থাকেন। ‘হোলি কে দিন দিল খিল যাতি হ্যায়’ গেয়ে ফাগুনি রোম্যান্সে মেতে বান্ধবীকে নিয়ে শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবে ‘না’। দোলের ভার্চুয়াল উদ্যাপন আঙুলের ডগায় চলা প্রযুক্তি। ফোন বা ল্যাপটপের পর্দায় ভার্চুয়াল মাধ্যমে ছোঁড়া রঙিন বেলুন। স্মার্টফোনের নানা অ্যাপের কারিগরির সঙ্গে জুড়েছে কৃত্রিম মেধা। মিলিয়ে ভার্চুয়াল দোলের পার্টি জমজমাট ভার্চুয়াল রং খেলায়। ফেসবুক, গুগ্ল, স্ন্যাপচ্যাট, হোয়াট্সঅ্যাপ সহ নানান সমাজমাধ্যমে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গ্রুপ ভিডিয়ো কল। অ্যাপে দোল খেলা ভার্চুয়াল রঙিন দুনিয়াতে কাটে সময়। টলমল পায়ের দোল মানে বেশীরভাগ জনের কাছেই খানার সঙ্গে পিনা। বাঙালি দোলের ‘রং’ অবাঙালি পানীয় ঠান্ডাই। নির্বান্ধব পরবাসে পছন্দের পানীয় আর খাবার নিয়ে বসছেন অনলাইন নিজেই নিজের গালে রং মেখে বাহাদুরি ‘চিয়ার্স’। একে বলে দূরত্বের দোল খেলা?
দোলের আগে ভাঙড়া নাচলেন মমতা। সামাজিক অনুষ্ঠানে ডান্ডিয়া নাচ। আদিবাসী রমণীদের সঙ্গেও মমতাই নাচলেন ভাঙড়া। ভাঙড়া নাচে পা মেলালেন, হাততালিও দিলেন নেত্রী। ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহের রাজ্য সরকারের উদ্যোগে দোল ও হোলির মিলন উৎসব। শিখ সম্প্রদায়ের অনেকে ছিলেন অনুষ্ঠানে। রবীন্দ্রসংগীত, ডান্ডিয়ার পর ভাঙড়া পরই বেজে ওঠে গান হায়ো রাব্বা বোলো তারা রারা..। প্রকৃত অর্থেই দোল, হোলির আগে মিলন উৎসবে মমতা জানিয়ে দিলেন পরের বার নেতাজি ইন্ডোরে আরও বড় করে করব। চলতি বছরের দোল ১৪ মার্চ। পঞ্জিকামতে ১৩ মার্চ থেকে পড়ছে দোল পূর্ণিমার তিথি। দোল পূর্ণিমার তিথি লক্ষ্মীবার বৃহস্পতিবার ১৩ মার্চ, অর্থাৎ বাংলা মতে ২৯ ফাল্গুন, বেলা ১০ টা ৩৭ মিনিট থেকে পড়ছে দোলপূর্ণিমা। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্তমতে পূর্ণিমা তিথি শেষ হবে ১৪ মার্চ, অর্থাৎ বাংলার ৩০ ফাল্গুন বেলা ১২ টা ২৫ মিনিটে। পূর্ণিমা তিথি বৃহস্পতিবার পড়লেও তা শেষ হচ্ছে শুক্রবার। গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকামতে বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ থেকে পূর্ণিমা তিথি বাংলায় ২৮ ফাল্গুন বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টা ২২ মিনিট ২৩ সেকেন্ডে শুরু। পূর্ণিমা তিথি শেষ ১৪ মার্চ ২০২৫ সালে শুক্রবার বাংলায় ২৯ ফাল্গুন সকাল ১১ টা ৩৩ মিনিট ৪৯ মিনিটে তিথি শেষ।