তিনি কিংবদন্তি। তিনি প্রাক্তন হলেও নিজের নাম নথিভুক্ত করেছেন সেরাদের তালিকায়। সহজ সরল নিপাট ভদ্রলোক। সর্বদা মাটিতে পা রেখে চলতে পছন্দ করেন। কম কথা কাজ বেশী তত্বে বিশ্বাসী। সম্প্রতি নিজের বর্ণময় কেরিয়ারে ইতি টেনেছেন। বিশ্বের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক। বাংলা ক্রিকেটে পঙ্কজ রায় ও সৌরভ গাঙ্গুলীর পর যাঁর নাম এক সুরে উচ্চারিত হয়। তিনি ‘সুপারম্যান’ ঋদ্ধিমান সাহা। গোধুলি পেরিয়ে আঁধার নামার পথে। সন্ধ্যার ইডেন গার্ডেন্সে চতুর্দিক আলোর ঝলকানি।

এতো আনন্দ আর আর আয়োজন তাঁরই জন্য। রবিবাসরীয় সন্ধ্যায় সুপারম্যানকে সম্মান জানাতে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন বঙ্গ ক্রিকেট সংস্থা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের। সুসজ্জিত মঞ্চে দেখা গেল একের পর এক চোখ ধাঁধানো দৃশ্য। এক মঞ্চে বাংলা ক্রিকেটের দুই কিংবদন্তি। সৌরভ গাঙ্গুলী ও ঋদ্ধিমান সাহা। বঙ্গ ক্রিকেটের আইকন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও কুর্নিশ জানালেন ঋদ্ধিকে। বিপুল আয়োজন দেখে মঞ্চে উঠে বলেই ফেললেন ‘‘আমার জন্য এত আয়োজন হবে ভাবতেই পারিনি। সিএবি-কে ধন্যবাদ এই দিনটি উপহার দেওয়ার জন্য।’’ সদ্য রঞ্জি মরশুম শেষে নিজের বর্ণময় কেরিয়ারে ইতি টেনেছেন বাংলার কিংবদন্তি উইকেটরক্ষক ঋদ্ধিমান সাহা। জীবনের শেষ ম্যাচটি খেলেন বাংলার জার্সিতেই। ঋদ্ধিমান সাহাকে সম্মান জানিয়ে তাঁর হাতে রুপোর দস্তানা উপহার হিসাবে তুলে দেন স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়।

ঋদ্ধিমান সাহাকে বিশেষ সংবর্ধনা সিএবি’র। মঞ্চের একদিকে ছোট্ট ডাগআউটে পরপর সাজানো ‘সাহা’ নামাঙ্কিত বেশ কয়েকটি জার্সি, সাদা-হলুদ-নীল রংয়ের। কোনওটা টিম ইন্ডিয়ার, কোনওটা বাংলার। সঙ্গে চেন্নাই সুপার কিংস, সানরাইজার্স হায়দরাবাদের জার্সিও। কিছু প্যাড, গ্লাভস, ব্যাট, টুপির সমাহার। অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগেই নিজের জার্সি এবং কিট দিয়ে তৈরি করা ডাগআউট দেখতে ছুটলেন ঋদ্ধি। তৎক্ষনাৎ সিএবির প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে পরিয়ে দিলেন রাজমুকুট। এরপর সিএবির দেওয়া রুপোর গ্লাভসে সম্মানিত হওয়ার পর একে একে আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজির উপঢৌকন। কলকাতা নাইট রাইডার্স, চেন্নাই সুপার কিংস, সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ, গুজরাট টাইটান্স, পাঞ্জাব কিংসের তরফ থেকে পাঠানো হয় উপহার সামগ্রী। ঋদ্ধিকে আগামী জীবনের শুভেচ্ছা জানানো হয় প্রত্যেকের তরফ থেকেই। প্রকাণ্ড এলইডি স্ক্রিনে ভেসে আসছে ভিভিএস লক্ষ্মন, দীনেশ কার্ত্তিক, শিখর ধাওয়ান, ঝুলন গোস্বামী সহ তারকাদের শুভেচ্ছাবার্তা। ঋদ্ধির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা। প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেটার উৎপল চ্যাটার্জ্জী, প্রাক্তন ভারতীয় উইকেটরক্ষক ও কমেনটেটর দীপ দাসগুপ্ত, বাংলা দলের অধিনায়ক অনুষ্টুপ মজুমদার, আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য অভিষেক ডালমিয়া উপস্থিত ছিলেন। বাংলা ক্রিকেট দলের কোচ লক্ষ্মীরতন শুক্লার অধিনায়কত্বে ক্রিকেট খেলেছেন ঋদ্ধি। আবার কোচ লক্ষ্মীর তত্বাবধানে রঞ্জি খেলে ক্রিকেটকে আলবিদা জানান ভারতসেরা উইকেটরক্ষক। মঞ্চে ঋদ্ধির বড় হওয়ার কাহিনী ব্যাক্ত করলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, ঋদ্ধির ছোটবেলার কোচ জয়ন্ত ভৌমিক, স্ত্রী রোমি, প্রাক্তন সতীর্থ লক্ষ্মীরতন শুরু, অনুষ্টুপ মজুমদাররা।

ঋদ্ধিমান সাহা ভারতীয় দল থেকে বাদ পড়ার সময় বিসিসিআইয়ের মসনদে ছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ঋদ্ধির বিদায়বেলায় তাঁকে ভূয়সী প্রশংসায় ভরিয়ে দেন সৌরভ। প্রাক্তন ভারতীয় উইকেটকিপারের প্রশংসা করে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘ভারতের সেরা উইকেটকিপার ঋদ্ধিমান। ধোনির ছত্রছায়ায় থেকে ৪০টি টেস্ট খেলা সহজ নয়। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ও ঋষভ পন্থের সময়কালে ভারতীয় দলের হয়ে সুযোগ পেয়ে ৪০টি টেস্ট ম্যাচ খেলাই ওর দক্ষতা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। অবশ্যই চাইব জীবনের পরবর্তী ইনিংসটা ভাল কাটুক। অবসর জীবনের জন্য ওকে শুভেচ্ছা।’ সিএবির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগঘন ঋদ্ধিমান বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল ইডেনে একটা ছক্কা হাঁকাব। সেই ইচ্ছা আমার পূরণ হয়েছে। অনেক কিছু পেয়েছি। আবার অনেক স্বপ্ন অধরাও রয়ে গিয়েছে। এইসবকিছুই মিলিয়ে মিশিয়েই আমার কেরিয়ার।’

অবসরের দিন ঠিক রবিবাসরীয় সন্ধ্যার মতোই ইডেনে ম্যাচে চেনা ভূমিকায় ছিলেন ঋদ্ধিমান। ঋদ্ধিকে সই করা জার্সি তুলে দিয়েছিল বাংলা দল। কাটা হয়েছিল কেক। হাজির ছিলেন সিএবি প্রেসিডেন্ট স্নেহাশীষ গাঙ্গুলী। কানায় কানায় পূর্ণ গ্যালারির একদিক। কলকাতায় রঞ্জি ট্রফির স্মরণীয় ঘটনা। ইডেন গার্ডেন্সে পেশাদার কেরিয়ারের শেষ ম্যাচ ছিল ঋদ্ধিমান সাহার। ক্লাব হাউসের আপার টিয়ার ভরে গিয়েছিল ঋদ্ধিকে শেষবার ম্যাচ খেলতে দেখার জন্য। দর্শকদের ঋদ্ধি-লাভ হয়েছিল। অবসরের ম্যাচ খেলতে নেমে উইকেটকিপিং করেছিলেন শিলিগুড়ির তারকা। ঋদ্ধিমানের বিদায়ী লগ্ন স্মরণীয় করে রাখতেই তাঁর হাতে উইকেটকিপিং গ্লাভস তুলে দেওয়া হয়েছিল সেদিন বাংলা দলের পক্ষ থেকে। ১৩ ওভার উইকেটকিপিং করে ঋদ্ধিমান দুটি ক্যাচও ধরেছিলেন। একটি সূরয সিন্ধু জয়সওয়ালের বলে। একটি সুমিত মোহান্তর বলে। তারপর উইকেটকিপিং গ্লাভস তুলে দিলেন অভিষেকের হাতে। ঠিক যেন আনুষ্ঠানিকভাবে রাজ্যপাট তুলে দিলেন উত্তরসূরির হাতে। ২০২৪-২৫ মরশুমে ঋদ্ধিমান রঞ্জি ট্রফিতে খেলছেন ব্যাটার হিসাবে। উইকেটকিপিং করেছিলেন চন্দননগরের অভিষেক পোড়েল। ঋদ্ধি স্লিপে ফিল্ডিং করেন।

ঋদ্ধিমান সাহা ভারতের হয়ে ৪০টি টেস্ট ও ৯টি ওয়ানডে খেলেছেন। ধোনির ব্যাকআপ হিসেবে থাকার পর, টেস্ট থেকে ধোনির বিদায়ের পর তিনি নিয়মিত সুযোগ পান। একাধিক চোটের কারণে অনেক ম্যাচ মিস করতে হয়েছে। ৪০ বছর বয়সি ঋদ্ধিমান সাহা ভারতের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলেন ২০২১ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। আইপিএলে ১৭০টি ম্যাচ খেলেছেন এবং সবচেয়ে স্মরণীয় পারফরম্যান্স ছিল আইপিএল ২০১৪ ফাইনালে পাঞ্জাব কিংসের হয়ে সেঞ্চুরি করা। ক্রিকেটার হিসাবে নিজের শেষ মরশুম।

ঋদ্ধিমান সাহা ভারতের হয়ে মোট ৪০টি টেস্ট ও ৯টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। টেস্টে ২৯.৪১ গড়ে ১৩৫৩ রান। সেঞ্চুরি করেছেন ৩টি ও হাফ-সেঞ্চুরি ৬টি। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস ১১৭ রানের। টেস্টে ৯২টি ক্যাচ নেন সাহা। স্টাম্প-আউট করেছেন ১২টি। ওয়ান ডে ক্রিকেটে ঋদ্ধির সংগ্রহ ৪১ রান। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৭টি ক্যাচ ও ১টি স্টাম্প-আউট করেন। ঋদ্ধিমান সাহা ১৪১টি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচে মাঠে নামেন। ৪১.৬৮ গড়। মোট ৭১৬৯ রান। সেঞ্চুরি ১৪টি ও হাফ-সেঞ্চুরি ৪৪টি। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস অপরাজিত ২০৩ রান। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ঋদ্ধি ৩৪৪টি ক্যাচ ধরেছেন। স্টাম্প-আউট করেন ৩৮টি। ঋদ্ধিমান সাহা লিস্ট-এ ক্রিকেটে মোট ১১৬টি ম্যাচ খেলেছেন। ৪০.৪২ গড়। ৩০৭২ রান। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে ঋদ্ধি ৩টি সেঞ্চুরি এবং হাফ-সেঞ্চুরি ২০টি। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসে ১১৬ রানের। লিস্ট-এ ক্রিকেটে সাহা ১৩৮টি ক্যাচ এবং স্টাম্প-আউট করেন ১৮টি। ঋদ্ধিমান সাহা কলকাতা নাইট রাইডার্স, চেন্নাই সুপার কিংস, কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব, সানরাইজার্স হায়দরাবাদ ও গুজরাট টাইটানসের হয়ে আইপিএল খেলেছেন। ঋদ্ধি ১৭০টি আইপিএল ম্যাচে মাঠে নেমে ২৪.২৫ গড়ে ২৯৩৪ রান করেছেন। আইপিএলে ১টি সেঞ্চুরি ও ১৩টি হাফ-সেঞ্চুরি করেন সাহা। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস ১১৫ রানের। আইপিএলে ৯৩টি ক্যাচ ধরেন ঋদ্ধি। স্টাম্প-আউট করেন ২৬টি।

গ্লাভস হাতে ভারতীয় দলের ভরসা হয়ে উঠেছিলেন উইকেটের পিছনে। পুণেতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে উমেশ যাদবের বলে স্টিভ ও’কিফের ক্যাচ ধরে হয়ে উঠেছিলেন সুপারম্যান ঋদ্ধিম্যান। কেউ কেউ নাম দিয়েছিলেন ফ্লাইং সাহা। যে ক্যাচ বিশ্বক্রিকেটে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঋদ্ধির বিদায়ী ম্যাচ দেখতে মাঠে হাজির ছিলেন স্ত্রী রোমি। ঋদ্ধিমান সাহার অবসরের মুহূর্ত চাক্ষুস করতে ইডেন গার্ডেন্সে দৌড়ে এসেছিলেন বাংলার সর্বকালের সেরা ফাস্টবোলার অশোক দিন্দাও। বিশ্বের উইকেটকিপারদের উজ্জ্বল তালিকায় নাম নথিভুক্ত করা কিপার পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ খেলেই জুতোজোড়া তুলে রেখেছিলেন। ঋদ্ধিকে গার্ড অফ অনার দিয়েছিল পাঞ্জাব।

ঋদ্ধিমানের রঙিন এক কেরিয়ার থেমে গেল সেদিনই। ঋদ্ধিমান সাহা হয়ে গেলেন প্রাক্তন ক্রিকেটার। উইকেটকিপার হিসাবে নিজেকে আলাদা উচ্চতায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল পাপালি। পুরোপুরি টিমম্যান। মাঠের বাইরে খুব ভাল মানুষ। অজাতশত্রু। কারও সঙ্গে কোনওদিন খারাপ ব্যবহার করেনি। আর কখনও অভিযোগ করেনি। শিলিগুড়ির ঋদ্ধি কলকাতায় আসার পর ঠিকানা ছিল শিয়ালদার কোলে মার্কেটের মেস ঘর। ২০০৩ থেকে প্রায় ২০১০ সাল পর্যন্ত। কত স্মৃতি। ঋদ্ধিমানের কেরিয়ারে যবনিকা পতন। ঋদ্ধিমান সিএবির হয়ে ক্রিকেটে নিজেক নিয়োজিত রাখতে অন্য ভূমিকাতে বাংলাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত।