বৈশাখে ‘বসন্ত’। আজ শনিবারই একষট্টিতে পা রাথা দিলীপের জীবনে! গতকাল শুক্রে গোধূলি লগ্নে রিঙ্কুর সঙ্গে চার হাত এক হওয়ার পর কেটে গেল একটা রাত। গতকালই ঘনিষ্ঠবৃত্তে সাদামাটা ভাবে বিয়ে সেরেছেন দিলীপ। গোধূলি লগ্নে বিয়ে হল দিলীপ ঘোষের। বর এবং কনেপক্ষ মিলিয়ে নিমন্ত্রিতের সংখ্যা ৪০ জন। চলেন নিজের মতে, নিজের পথে। শুক্র সন্ধ্যা ‘ছাঁদনাতলা’য় পাত্র দিলীপ ঘোষ। নিজের নিউ টাউনের বাড়িতেই। বধূবেশে পাত্রী রিঙ্কু মজুমদার। ঘরেই বিয়ের আসর। গোধূলি লগ্নে এক হল চার হাত। দিলীপের ইচ্ছামতো গাঁটছড়া বাঁধা। সাক্ষী শুধুই বর-কনের পরিবার। ঘনিষ্ঠ কয়েক জনও ছিলেন। বিয়ে পর্ব শেষে রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি জানান, মায়ের দায়িত্ব যাতে আরও ভাল ভাবে পালন করতে পারেন, তাই এই সিদ্ধান্ত। দিলীপ বলেন, ‘‘আমি যাতে জীবনের দায়িত্ব আরও ভাল ভাবে পালন করতে পারি, মায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারি, তাই এই সিদ্ধান্ত। উনি সংসার সামলেছেন। অভিজ্ঞতা আছে। দু’জনেরই রাজনৈতিক জীবন থাকবে। তার সঙ্গেই আমরা পারিবারিক জীবন কাটাব। আমার মা খুব খুশি। মায়ের কথাতেই এই বিয়ে। মা নিজে রিঙ্কুর বাড়িতে থেকে এসেছেন। আমার অনুপস্থিতিতে আমার মাকে রান্নাবান্না করে খাইয়েছে রিঙ্কু। অ্যাডজাস্টমেন্ট অনেকটা হয়েই গিয়েছে। বাকিটা ভগবানের ইচ্ছা। রিঙ্কুও দলের কর্মী। দল যে দায়িত্ব দেবে, শক্তি, সামর্থ দিয়ে সেই কাজ করব আমরা।’’ লাল বেনারসি, গলায় ভারী হার কনে পরে রিঙ্কু-দিলীপের শুভদৃষ্টি, মালাবদল করে সম্পন্ন দাবাং নেতার বিয়ে। রাজনৈতিক দায়িত্ব থেকে সরছেন না। দিলীপের পাশে থাকার বার্তা নববধূ রিঙ্কুর। রিঙ্কুর কথায়, ‘‘পার্টি ওকে যে ভাবে দেখতে চায়, সে ভাবেই পাবে। এটাই আমি নিশ্চিত করতে চাই।’’

দিলীপের বয়স আজই ৬১। বিয়ের পক্ষে-বিপক্ষে বহু মন্তব্য। মায়ের ইচ্ছাতেই বিয়ে। রীতি-আচার মেনে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি-টোপর পরে ছাঁদনাতলা উপস্থিত ছিলেন দিলীপ। আর কনের সাজে রিঙ্কু। পরনে লাল বেনারসি। মাথায় শোলার মুকুট, কপালে ছোট টিপ, মাথায় লাল ওড়না। নিউ টাউনের এক শপিং মলের পার্লারে শুক্রবার দুপুরে সাজতে গিয়েছিলেন রিঙ্কু। সেখান থেকেই বিকেলে সোজা দিলীপের নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে। সঙ্গে ছিলেন জনা পনেরো কনেযাত্রী। রিঙ্কু বিবাহবিচ্ছিন্না। আছে সেই পক্ষের এক পুত্রসন্তান। সল্টলেকের একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করেন রিঙ্কুর ছেলে সৃঞ্জয়। গুড ফ্রাইডের ছুটি কাটাতে কলকাতার বাইরে থাকলেও, মায়ের এই সিদ্ধান্তে ছেলে ভীষণ খুশি। দু’জনের জন্য উপহারও আনবেন বলে জানিয়েছেন সৃঞ্জয়। বিয়ের আসরে কোনও হাইপ্রোফাইল নেতাকে দেখা যায়নি। বিয়ের ভোজের তালিকাও আড়ম্বরহীন। খাবারের তালিকায় বাঙালিয়ানা। লুচি, তরকারি, পোলাও। ছিল মাছের পদ একরকমই। মাংস ছিল না। শেষপাতে মিষ্টি।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুভেচ্ছাবার্তা-সহ ফুলের তোড়া। সৌজন্যের নজির দেখিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কার্ডে লিখেছেন, ‘‘শ্রীমতী রিঙ্কু মজুমদারের সঙ্গে আপনার বিবাহবন্ধনের কথা জেনে আনন্দিত হলাম। জীবনের এই নতুন অধ্যায়ের সূচনায় রিঙ্কুদেবী ও আপনাকে আমার অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। মঙ্গলময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আপনাদের যৌথ জীবন সুখের হোক। ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।’’ শুভেচ্ছা বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার, প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়-সহ দলের একাধিক নেতাদের। উপহারও। ফুলের তোড়া, মিষ্টির বাক্স, ধুতি-পাঞ্জাবি। দিলীপ সকলকে প্রতি-উপহার দিয়েছেন। লকেটকে দিয়েছেন শাড়ি। কাউকে পাজামা-পাঞ্জাবির সেট। কাউকে পাঞ্জাবি বানানোর কাপড়। কাউকে দিয়েছেন ধুতি। অতিথি আপ্যায়নে করেন দিলীপ ঘোষের মা পুষ্পলতা ঘোষ। শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। প্রেমিকার সঙ্গে শুভ পরিণয় সম্পন্ন। রাফ অ্যান্ড টাফ রাজনীতিবিদ দিলীপ ঘোষ সংসারি। জীবনের ষাট বসন্ত পার করা দিলীপ ঘোষ বঙ্গ বিজেপির রঙিন চরিত্র। সংঘের প্রচারক থেকে বিধায়ক, সাংসদ, রাজ্য সভাপতি, সর্বভারতীয় সহ সভাপতি হয়েছিলেন বিজেপির দলের।

বাউন্ডুলে দিলীপ ঘোষের সহধর্মিণী রিঙ্কু মজুমদার। মায়ের আদরের গোপীবল্লভপুরের ‘নাড়ু’ অর্থাৎ দিলীপ ঘোষের মধুরেণ সমাপয়েৎ। ছেলের বিয়ে দেখে খুশি মা পুষ্পলতা। নিউ টাউনে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষ। ভোর সাড়ে ৫টার মধ্যে ইকো পার্কে হাঁটা শুরু। বলেন, স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ ইকো পার্কে হয়নি। ইকো পার্কে হাঁটলে আদৌ কারও বিয়ে হয় না! বিয়ে যখন হওয়ার, তখনই হয়। দিলীপ বলেন, ‘‘রিঙ্কু মজুমদারের সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছিল। উনি পুরনো পার্টি কর্মী। রাজনীতিতে উনি ২০১২ সালে এসেছেন। আমি এসেছি ২০১৫ সালে। বিয়ে করার ব্যাপারটা হঠাৎই এসেছে, আর সেটা পরিস্থিতির কারণে। সেটা হয়েও গেছে যথা সময়ে। অনেকে ভাবছে ইকো পার্কে হাঁটলেই বিয়ে হয়। সারাজীবন হাঁটলেও বিয়ে হবে বিয়ে যখন হওয়ার তখনই হবে।’’ দিলীপের জন্মদিন খাতায়কলমে ১ আগস্ট। তিথি মেনে প্রতি বছর ১৯ এপ্রিল তিনি জন্মদিন পালন করা হয় বাড়িতে। বিয়ে এবং জন্মদিন উপলক্ষে শনিবার ইকো পার্কে অল্পকিছুর আয়োজন। ৬টায় হইহুল্লোড়। ঠিক ছিল, আজ প্রায় ১৫০ জনকে ইকোপার্কে ইডলি খাওয়াবেন দিলীপ ঘোষ। ইডলি এবং চাটনির ডাব্বাও আনা হয়ছিল ইকোপার্কে। তিনটি কেক কেটে সেখানে আগত ব্যক্তিদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করেন দিলীপ ঘোষ। কেউ বাড়ি থেকে পায়েস বানিয়ে বা বাড়িতে বানানো কেক অথবা মিষ্টির দোকানে বিশেষ অর্ডার দিয়ে মিল্ককেক, দইবড়াও। দিলীপের মিষ্টি খুব একটা পছন্দের না। জন্মদিনে কেকও কাটেন না। শনি ঘনিষ্ঠবৃত্তের আবদার মেটাতে মিষ্টি, কেক, পায়েস, দইবড়া রসনাতৃপ্ত করেন। অন্যদেরও খাইয়ে দিয়েছেন। শনিবার ১৯ এপ্রিল দিলীপ ঘোষের জন্মদিনের প্রাতঃভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরবেন। বিকেল ৫টায় দমদম সুভাষনগর ময়দান থেকে নাগেরবাজার পর্যন্ত মিছিল করবেন দিলীপ। রাতে খড়্গপুর যাবেন। জন্মদিনেই দমদমে দলীয় সভা সেরে বিকেলে সস্ত্রীক খড়গপুরে রওনা দেবেন। সেখানেও জন্মদিন পালন করা হবে। খড়্গপুরে দিলীপ একটি বিয়েবাড়ির নিমন্ত্রণও রক্ষা করবেন। রবিবার সকালে চা চক্র। সোমবার কলকাতা ফিরবেন।এতোদিন ‘দিলীপদা’ নাম সেভ করে রেখেছিলেন ফোনে। বিয়ের পরেও রিঙ্কু হাজ়ব্যান্ড বলে সেভ করার কথাও জানালেন। ’বিয়ের পর রিঙ্কু নিজের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে বলেন, ‘‘উনি বলেছেন, তুমি আশা কোরো না আমি তোমাকে শপিং করাতে, ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে যাব। আমি বলেছি, ঠিক আছে। বাকি সহধর্মিণী হিসাবে যা দায়িত্ব, তার সবই পালন করব।’’ মধুচন্দ্রিমা কোনও আইসোলেটেড জায়গায়। চক আউট মধুচন্দ্রিমারও পরিকল্পনা। কোথায় যাবেন নবদম্পতি? দেশের মধ্যেই? রিঙ্কুর পাহাড় পছন্দ। নিরিবিলি কোনও পাহাড়ি এলাকা। হিল স্টেশনে যাবেন মধুচন্দ্রিমা করতে দিলীপ রিঙ্কু। হিমাচলপ্রদেশের শিমলা?

রিঙ্কু মজুমদারের সঙ্গে নতুন জীবন শুরু। দিলীপ ঘোষের বয়স ষাটের কোটায় তাই জুটেছে অনেক কটূক্তি, ব্যঙ্গ আর বাঁকা হাসি। তাঁর এই বিয়ে নিয়ে অনেকের মনে জলঘোলার অভ্যাস। ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের প্রসঙ্গ উঠলে তৃণমূলকে কটাক্ষ করে দিলীপ বলেন, ‘‘দল আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে, বরাবর তা পালন করে এসেছি। মানুষ যখন মনে করবে, তখনই রাজ্যে পরিবর্তন আসবে। সেটা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। সবসময় জনতাই শেষ কথা বলে। তা তারা বলতে শুরু করেছে।’’ সেলেবরা অবশ্য দিলীপের পক্ষেই। সেলেবরা বলেন, কোথায় লেখা আছে, ৪০ পেরিয়ে গেলে আর বিয়ে করা যাবে না! দিলীপবাবুর যখন মনে হয়েছে তখন তিনি বিয়ে করেছেন। বয়স তো সংখ্যার বাইরে কিছুই না। উনি তো, তৃণমূলের পার্থ-বালুর বা আরও অন্যান্যদের মতো পরকীয়া বা লিভ-ইন নন। বরং বিয়ে করে নজির গড়লেন তিনি।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে পূর্ব ভারত ক্ষেত্রের সহ-প্রচার প্রমুখ জিষ্ণু বসু সত্যকাম ও জবালাকে নিয়ে লেখা কবিগুরুর কবিতার উদ্ধৃতি টেনে বলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর ব্রাহ্মণ কবিতায় লিখেছিলেন ‘মধুচক্রে লোষ্ট্রপাতে বিক্ষিপ্ত চঞ্চল/পতঙ্গের মতো– সবে বিস্ময়বিকল’। এটা সেরকমই! আমাদের যত না কিছু মনে হচ্ছে, যাঁরা সারা জীবনে কখনও আমাদের খবর নেন না, তাঁদের মনে এখন বেশি অশান্তি হচ্ছে এই ভেবে যে দিলীপ ঘোষ কেন বিয়ে করছে?” আরএসএসের অন্যতম শীর্ষ পদাধিকারীর কথায়, ‘‘ সংঘের নিয়ম অনুযায়ী সংঘে কেউ যোগদান করলে প্রথমে তাঁকে বিস্তারক হিসাবে কাজ করতে হয়। সেই সময় তাঁদের মানসিকতা দেখে প্রচারক পদে উন্নীত করা হয়। প্রচারক ও অ-প্রচারকের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে যে সংঘ তাঁর খরচ চালায় কি না। এই খরচকে ‘বিত্তপত্তক’ বলে। সংঘ যদি কারও খরচ না চালায়, তবে তিনি প্রচারক নন। দিলীপ ঘোষের খরচ বহুদিনই, প্রায় ১০ বছর সংঘ চালায় না। তাই দিলীপ ঘোষ এখন প্রচারক নন। দিলীপ ঘোষ বহুদিন থেকেই প্রচারক নন। দিলীপ ঘোষ বিয়ে করতেই পারেন। তাঁর মনে হয়েছে তিনি বিয়ে করবেন। তাতে কারও কিছু বলারও নেই। আর আমাদের তাতে কোনও টেনশন নেই।’’
