আমার বয়স যখন দেড় মাস, ঠিক তখন আমি পোলিও নামক একটি ভয়ঙ্কর ভাইরাসে আক্রান্ত। আমাদের পারিবারিক পরিস্তিতি এতটাই খারাপ ছিল যে আমার মা-বাবা আমার চিকিৎসা করার মতো সামর্থটুকু অবধি ছিল না। কিঞ্চিৎ সময় ব্যয় না করে আমাকে বেলেঘাটার শিশু হসপিটালে ভর্তি করান। আমার চিকিৎসা প্রায় ২ বছর ধরে চলতে থাকে। আমার বয়স যখন ২ বছর, আমি হাঁটা তো দূর, আমি ঠিক মত দাঁড়াতে পারতাম না। ফিজিওথোপি চলতে থাকে প্রায় আরও আড়াই বছর। তখন আমার মা এবং বাবাকে একজন চিকিৎসক পরামর্শ দিলেন আমার ডান পা পুরোপুরি ঠিক করার জন্য আমাকে সাইকেল ও সাঁতারে দিতে। অপেক্ষা না করে আমাকে সাঁতারে ভর্তি করিয়ে দিলেন এবং সাইকেল দিলেন যাতে আমি আবার হেঁটে চলে স্কুলে যেতে পারি। সবসময় মা এবং বাবাকে জিজ্ঞাসা করতাম, আমি কবে সবার মত দৌড়ে খেলাধুলা করতে পারবো? কবে আমি সবার মত দৌড় প্রতিযোগিতার অংশগ্রহণ করতে পারব? খুব খারাপ লাগতো এবং নিজে নিজেকেই প্রশ্ন করতাম, আমি কি সত্যি খেলাধুলা কিংবা সব বাচ্চাদের মত দৌড়তে পারবো? সাঁতার শুরু করলাম সালকিয়া সুইমিং এ্যাসোসিয়েশনে। প্রথমে খুব ভয় পেতাম। আস্তে আস্তে নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখলাম জলের সাথে।
আমার জীবনে প্রথম ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ ২০০৩ সালে। বোম্বেতে ৩টি রৌপ্য ও ১টি স্বর্ণ পদক জিতি। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আমি মোট ১৮টি জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে এবং ২টি জাতীয় সাঁতার গেমসে অংশগ্রহণ করে ৫১টি স্বর্ণ, ৩৯টি রৌপ্য এবং ১৮টি কাশ্য পদক সহ ৫টি জাতীয় রেকর্ড করি। ২০০৮ সালে কর্নাল, হরিয়ানা ন্যাশনাল। ২০১০ দিল্লি কমনওয়েলথ গেমসের জন্য সিলেকশন। শুরু ইন্টারন্যাশনালের যাত্রা। ন্যাশনাল এর পাশাপাশি আন্তজার্তিকস্তরেও ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব। ২০০৯ সালে প্রথম ওয়ার্ল্ড গেমসে রৌপ্য পদক জয় ১০০মিটার বাকট্রোকে। ২০১০ সালে দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমসে ভারতের হয়ে বাংলার হয়ে সর্বকনিষ্ঠ সাঁতারু হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে পঞ্চম স্থান অধিকার। ২ মাস পরে চীনে প্যারা-এশিয়ান গেমসে প্রতিনিধিত্ব ৫০ মিটার ফ্রি-ষ্টাইল ইভেন্টে। এরপর প্যারা-এশিয়ান গেমস। ২০১২ সালে লন্ডন প্যারা অলিম্পিকসে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ। দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্যাম্পে থেকে নিজেকে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করছিলাম। ১০০ মিটার এবং ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল এ ভালো ফল করার দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। ২০১১ সালের শেষের দিকে আমরা জানতে পারি যে প্যারালিম্পিক কমিটি অফ ইন্ডিয়া সাসপেন্ডেড হয়ে যায় এবং আমাদের সেখানে যাওয়ার জন্য মোট ৩.৫০ লাখ টাকার প্রয়োজন মেটাতে হবে। একজন বেসরকারি সিকিউরিটি গার্ডের চাকরির করা বাবার জন্য সাড়ে লক্ষ টাকা একটা পাহাড় সমান। সেই সময় আমার সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা শেষ। একসময় আমি সাঁতার জীবন থেকে সরে আসতে বাধ্য হই। কিছু বছর জল থেকে আলাদা থাকার পর আবার জলে ফেরার স্পৃহা। কারণ আমি হয়তো জল থেকে সরে যাচ্ছিলাম কিন্তু জল ততই আমাকে আরো কাছে টানছিল।

আবার শুরু থেকে শুরু করলাম। ন্যাশনাল শুরু। পাশাপাশি ওপেন ওয়াটার সাঁতারও। ২০১৪ সালে আমি মুম্বইয়ে। ৫ কিলোমিটার আরব সাগরে ওপরে সাঁতার। জীবনের প্রথম সমুদ্রের অভিজ্ঞতা খুবই ভালো। ভয়ও হচ্ছিল। চতুর্থ স্থান লাভ করে ওপেন ওয়াটারের জীবন শুরু। ২০১৫ সাল থেকে টানা প্রত্যেক বছর গুজরাটের পোরবন্দরে ৫ কিলোমিটার ও ২কিলোমিটার ওপেন ওয়াটার সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন। মন কিছুতেই মানছিল না প্যারালিম্পিকস এর ব্যথা। ২০১৭ সালে একটি টিম গঠন করলাম। আরও ৩ জন প্রতিবন্ধী সাঁতারু নিয়ে রিলে ইংলিশ চ্যানেল পার। এত টাকা পাবো কোথায়। এগিয়ে গেলাম পকেটে ৪ হাজার ৫০০ টাকা নিয়ে। ২৪শে জুন ২০১৮ সাল। ভারতের হয়ে সর্বপ্রথম প্যারা সাঁতারু হিসাবে ইংলিশ চ্যানেল রিলেতে সাঁতার। যাত্রাটা খুব একটা মসৃণ ছিল না। ৪ জন মিলে যাই রতন টাটা ট্রাস্ট অফিসে। তারা ভরসা দেন আর্থিক সাহায্য করার। ইংলিশ চ্যানেল পর করার ৭ মাস আগে থেকে পুনেতে সপ্তসিন্ধু পর করা প্রথম ভারতীয় কোচ রোহান মোরের কাছে গিয়ে ট্রেনিং। তিনি রাস্তা দেখিয়েছিলেন চ্যানেল সুইমিংয়ের। ২০২৮ তে প্রথম ইংলিশ চ্যানেল পার করার অভিজ্ঞতা। প্রথমত জানতাম না। ইংলিশ চ্যানেল কি। কিংবা সেখানকার আবহাওয়া ও সেখানকার জলের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। সাঁতার কাটতে নামার দিন, ২৪ জুন ২০১৮। ইংলিশ চ্যানেল বা ব্রিটিশ চ্যানেল সম্পর্কে সাময়িক ধারনা এলো। কনকনে ঠান্ডা জল সঙ্গে প্রচণ্ড স্রোত। সকাল ৭.৩০ নাগাদ সাঁতার শুরু করার ২ ঘণ্টা পর আর এগোতে পারছিলাম না। জলের স্রোত প্রচন্ড পরিমাণে পিছন দিকে অর্থাৎ ইংল্যান্ডের দিকে টানছে। বেলা ১২টায় সাগরে মাঝে গিয়ে পড়লাম এবং জেলি ফিশের আনাগোনা। যতই এগোচ্ছি ততই জেলি ফিশের আনাগোনা আর আক্রমণ বাড়ছে। পরিস্থিতি ক্রমশই খারাপের দিকে। সকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। সাঁতার শেষ হচ্ছে না। আমরাও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। শেষ করে উঠবো না। কারণ, আমাদের টাকাপয়সা থেকে শুরু করে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বন্ধক। রাত ৮ টা ২৬ মিনিটে শেষ করলাম ফ্রান্সের মাটিতে। তৈরি হল রেকর্ড। জাতীয় ও এশিয়ান রেকর্ড সহ ফ্রান্সের মাটিতে ভারতের পতাকা ওড়ানো।
২০১২ সালের স্বপ্ন পূরণ হলো ২০১৮ তে। ইংলিশ চ্যানেল জয়। লক্ষ্য হচ্ছে সপ্তসিন্ধু পার। বাড়ি ফিরে কোনরকম ভাবে বিশ্রাম না নিয়ে আবারও পরের লক্ষ্য। পুনেতে কোচের কাছে। রোহান স্যার পরামর্শ দেন আমেরিকার ক্যাটালিনা চ্যানেল জয়ের। আবারও প্রস্তুতি শুরু। আমেরিকার যাওয়ার পথের কাটা আর্থিক পরিস্থিতি। আবারও সেই টাটা ট্রাস্টের সহানুভূতির আশা। প্রতিশ্রুতির মত আর্থিকভাবে সাহায্য করলেন। সিংহভাগ জোগাড় করা আমার কাছে সম্পূর্ণভাবে একটি যুদ্ধের মত ছিল। আমার মা, মহিলা সমিতি থেকে প্রায় ৪.৫ লক্ষ্য টাকার লোন নিলেন এবং পুরোটা আমেরিকার যাত্রার জন্য খরচ হয়। আজও সেই টাকার সুদ গুনতে হয়। প্রতিবন্ধীদের দেখার জন্য কেউ নেই।

২০১৯ সালে পরপর দুবার কাটালিনা চ্যানেল পার করি রিলেতে। ক্যাটালিনা চ্যানেলটি সাঁতারটি ছিল সম্পূর্ণ প্রশান্ত মহাসাগরে। ক্যাটালিনা আইল্যান্ড থেকে লস-এঞ্জেলেসের হারবার পর্যন্ত। প্রশান্ত মহাসাগরের একটু সাঁতারেই হাঙরের উপদ্রপ। সেই কারণে সাঁতার সাধারণত রাতের দিকে শুরু হয়। যাত্রা শুরু ১৪ই আগস্ট ২০১৯ সালের রাত ১১ টা ০৫ মিনিটে। যাত্রার প্রথম ধাপটা মসৃণ হলেও বুকের ভিতরে খুব ভয় ছিল। কারন হাঙরের উপদ্রপ বেশি। বোটের পাইলটের কথা মত সাঁতার। রাতের জলে গভীর অন্ধকার। জলের সামনে অন্ধকার। জলের ওপরেও অন্ধকার। কোনরকম ভাবে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই জলে নেমে সাঁতার। প্রার্থনা আমেরিকার বুকে ভারতের পতাকা যেন তুলে ধরতে পারি। সারারাত সাঁতার কাটার পর ভোট ৫ টা নাগাদ ভোরের আলো দেখতে পেলাম। পাইলট কে জিজ্ঞাসা করলাম যে আর কতটা পথ বাকি? হেসে উত্তর এলো, যতটা এসেছি ঠিক ততটা। বললেন লাগলো keep Swimming। নির্দেশ অনুযায়ী সাঁতার চলল। বেলা ১০.৩৫ তখন দেখতে পেলাম লস-এঞ্জেলেস সামনে প্রায় ৯ কিলোমিটার। একটু এনার্জি ড্রিংক খেয়ে আবারও সাঁতার। ১২টা ৪৬মিনিটে ল্যান্ড করলাম এবং পতাকা ওড়ালাম। এবারের অভিজ্ঞতা কিছুটা হলেও আলাদা। ভয় ছিল খালি স্টিং রে আর হাঙরের। সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে ডলফিনের সাথে সাঁতার কেটে হাজির লস এঞ্জেলেস। তারপর নিজেকে প্রস্তুত করলাম নর্থ চ্যানেল এর উদ্দেশ্যে। ২০১৯ এর শেষের দিকে প্রস্তুতি। ২০২০ সালে নর্থ চ্যানেল পার করার আশায় বাধ সাধলো করোনা ভাইরাস। প্রায় ২ বচ্ছর ঘরে বসেছিলাম। ২০২০ এবং ২০২১ কখনো ভোলার নয়। ২০২২ সালে পার করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলাম। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের নর্থ চ্যানেল পার। এবার সিদ্ধান্ত ইংলিশ চ্যানেল পারাপার। ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্স থেকে আবার ইংল্যান্ড ফেরা। সম্পূর্ণভাবে করতে পারলেই এশিয়ায় রেকর্ড। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে সফল হল যাত্রা। তৈরি হলো নতুন এশিয়ান রেকর্ড।

ধৈর্য এবং মানসীক দৃঢ়তাকে সম্বল করে আবারও ব্লুবার্গ থেকে রবেন দ্বীপ সাঁতরে যাওয়া ও ফিরে আসার চ্যালেঞ্জিং সাঁতার সফলভাবে সম্পন্ন করেছি। ৯ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার বরফের জলে দ্বিমুখী চ্যানেল সাঁতার। অপ্রত্যাশিত স্রোত। সামুদ্রিক যাত্রাপথে সীল এবং জেলিফিশের সাথে লড়াই ছিল। কঠিন পরিস্থিতি সত্ত্বেও এগিয়ে গিয়েছি। প্রথম ভারতীয় প্যারা সাঁতারু হিসেবে আইকনিক সাঁতার সম্পন্ন করে একটি নতুন জাতীয় রেকর্ড তৈরি করার সৌভাগ্য অর্জন করলাম। অধ্যবসায় এবং আবেগই শক্তির প্রমাণ। স্বপ্নের পিছনে দৌড় চলবেই। প্রতিকূলতা সবরকম বাধা পেরিয়ে নির্বিশেষে ঠিক পৌঁছে যাবে এক অচিন সীমানায়।
আমি প্রতিবন্ধী। বড় প্রতিবন্ধকতা একটা সরকারি চাকরি পেলাম না। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ। একটু দেখুন, আমার মা এবং বাবাকে আমি হাসিমুখে দেখতে চাই।
লেখক : রিমো সাহা
ইংলিশ চ্যানেল জয়ী সাঁতারু