অনুব্রতর নিরাপত্তায় কাটছাঁট! থানার আইসি’কে হুমকি বিতর্ক। অনুব্রত মণ্ডলের নামে এফআইআর। সরানো হল যাবতীয় নিরাপত্তা। এবার কিচ্ছুটি পাবে না কেষ্ট? অনুব্রত মণ্ডলকে ঘিরে তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি। পুলিশের পদস্থ কর্তাকে কদর্য ভাষায় অনুব্রতর হুমকির অডিয়ো ভাইরাল। দিনভর সরগরম থাকে বাংলার রাজনীতি। বীরভূমে তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার নামে দায়ের হয়েছে এফআইআর। মামলায় জামিন অযোগ্য ধারাও যুক্ত হয়েছে বলে খবর। দলের তরফে কেষ্টর জন্য বড় নির্দেশ। নির্দেশ পেয়েই ক্ষমা চান কেষ্ট। ঘটনার পরই পুলিশি নিরাপত্তা সরে যায় অনুব্রতর। অতীতে পুলিশকে হুমকি দেওয়ার নজির প্রচুর আছে অনুব্রতের। কখনও পুলিশের উদ্দ্যেশে বোমা মারতে দলীয় কর্মীদের নিদান দিয়েছেন। কখনও আবার ঘড়ি দেখিয়ে পুলিশ আধিকারিককে বলেছিলেন, ‘‘এখন বিকাল ৪টে বাজে। রাত ৮টা পর্যন্ত আপনাকে সময় দিলাম। না হলে আমি ঢুকে যাব। ভয়ঙ্কর খেলা খেলে দেব। একটা বাড়িও আস্ত রাখব না। একদম চড়িয়ে দেব। সব ক’টাকে অ্যারেস্ট করুন। এক ধার থেকে অ্যারেস্ট করুন!’’ কিন্তু পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কার্যত পাশে থেকেছিল দলও। কিন্তু এ বার আর তা হল না। আইসিকে কদর্য ভাষায় হুমকি কাণ্ডে ৪ ঘণ্টার মধ্যে অনুব্রতকে ক্ষমা চাইতে বলে তৃণমূল। ডেডলাইন শেষের আগেই ক্ষমা চান বীরভূমের তৃণমূলের এই নেতা। চিঠি লিখে ক্ষমা চেয়ে অনুব্রতর প্রশ্ন, ‘বিজেপি কীভাবে আইসির সঙ্গে আমার কথাবার্তার ফুটেজ পেল? কোনও চক্রান্ত নেই তো?’ এর আগেও, বীরভূমের আইসিকে দেওয়া অনুব্রতর হুমকির অডিয়ো ক্লিপ সামনে আনেন বিজেপির সুকান্ত মজুমদার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেছিলেন, অনুব্রতর মাথায় অক্সিজেন খুব কম ঢোকে।

অনুব্রত মণ্ডলের ডবল ডিগবাজি। জেল থেকে ফেরার পর আবার আগের ফর্মে। জেলা সভাপতি পদও সম্প্রতি চলে গিয়েছে। এ বার বোলপুর থানার আইসি লিটন হালদারকে হুমকি দেওয়ার ভাইরাল অডিয়ো-কাণ্ডের পরে দলের কোপে। অনুব্রতের বীরভূম জেলার শ্রেষ্ঠ আসন খোয়া গেল? রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন। অনুব্রত মণ্ডলের ক্ষমা প্রার্থনা চিঠি, ‘রাতে অনেক ওষুধপত্র খাই তো! এখন আমি রাত ১০টায় ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের ওষুধ খেতে হয় আমাকে। তখন আমি নিজের রাগ সামলাতে পারিনি। আমি এই কথা বলেছি। সে জন্য আমি দুঃখিত। পুলিশকে আমি প্রচণ্ড সাহায্য করি। পুলিশকে আমি ভালবাসি। পুলিশ বিপদে পড়লে আমি তাদের পাশে দাঁড়াই।’ ভাইরাল হওয়া একটি অডিয়ো ক্লিপ ঘিরে তোলপাড় বীরভূম জেলা তৃণমূলে। নড়েচড়ে বসে প্রশাসনও। যে ভাইরাল অডিও ক্লিপটিতে, অনুব্রত মণ্ডল নিজে বোলপুরের আইসিকে হুমকি দিতে শোনা যাচ্ছে। ডেপুটেশন দিতে গিয়ে থানা থেকে বার করে আইসিকে পেটানো হবে। শুধু তাই নয়, বোলপুর থানার আইসির মা এবং স্ত্রীর উদ্দেশে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ। মিছিলের জমায়েতে পুলিশি রিপোর্ট নিয়ে আইসির বিরুদ্ধে তোপ দাগা। ঝড়ের বেগে তা ছড়িয়ে পড়া বিশ্রী ভাষার অডিয়ো ক্লিপের জেরে চাপা পড়ে যায় আলিপুরদুয়ারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ এবং তার পাল্টা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাবি সাংবাদিক বৈঠক।

কমে যায় অনুব্রত মণ্ডলের অতিরিক্ত পুলিশি নিরাপত্তা। ওয়াই ক্যাটেগোরির পরও কেষ্ট যে অতিরিক্ত নিরাপত্তা পেতেন, তা সরানো হয়েছে। পুলিশের তাবড় কর্তাকে হুমকি বিতর্কের পর অনুব্রত মণ্ডলের ৫ জন হাউস গার্ডকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বীরভূমের তাবড় নেতা কেষ্ট মণ্ডলের ৪ জন নিরাপত্তারক্ষীকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে খবর। এছাড়াও অনুব্রত মণ্ডলের জন্য বরাদ্দ একটি গাড়িও সরানো হয়েছে। বোলপুর থানার আইসি লিটন হালদারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনুব্রতের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ধারায় মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। বীরভূমের পুলিশ সুপার আমনদীপ বলেন, ‘‘মিস্টার অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস)-র ২২৪ (সরকারি কাজে বাধা দেওয়া ও কর্তব্যরত কর্মীকে হুমকি), ১৩২ (সরকারি কর্মচারীকে হেনস্থা), ৭৫ (শ্লীলতাহানি ও হেনস্থা) এবং ৩৫১ (হুমকি) ধারায় মামলা রুজু হয়েছে।’’ পরে অনুব্রতকে বোলপুর পার্টি অফিসে গিয়ে নোটিসও দিয়ে এসেছে পুলিশ। বীরভূমে থানা থেকে গিয়ে অনুব্রতর অফিসে নোটিস পাঠানো হয়। বীরভূমের এই দাপুটে তৃণমূল নেতাকে শনিবার থানায় হাজিরা দিতে বলা হয়েছে।
তৃণমূলের ভুমিকা নিয়েও প্রশ্ন। অনুব্রতর বিশ্রী আচরণের পরও দল বিরাট কোনও পদক্ষেপ নিতে ভয় পাচ্ছে? অনুব্রত প্রশ্নে দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের নো কমেন্টস্। সমাজমাধ্যমে তৃণমূলের তরফে শুধু বলা হয়, চার ঘণ্টার মধ্যে অনুব্রতকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। তৃণমূল বলে, পুলিশের বিরুদ্ধে অনুব্রত মণ্ডল যা বলেছেন, তা দল অনুমোদন করে না। যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, দলের তরফে তার নিন্দা করা হচ্ছে।চাপের মুখে শেষমেশ বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা অনুব্রতর ক্ষমা চাওয়া। ক্ষমা চাওয়ার প্রথম চিঠি, ‘আমার ওই কথাগুলো বলা উচিত হয়নি। আমি দুঃখিত। বোলপুরের আইসির সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের অডিয়ো কী ভাবে ফাঁস হল? পুলিশের এক জন সাধারণ কর্মী থেকে বড় অফিসার সকলেই রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছের। তাঁদের অপমান করার কথা তিনি ভাবতেই পারি না। সাম্প্রতিক ঘটনায় আমি দুঃখিত। দিদির পুলিশের কাছে এক বার কেন, একশো বার ক্ষমা চাইতে পারি। আসলে আমি নানা রকম ওষুধ খাই। দিদির পুলিশের বিরুদ্ধে কেউ কোনও অভিযোগ করলে মাথা গরম হয়ে যায়। সতিই আমি দুঃখিত।’ কেষ্টর মান্যতা কণ্ঠস্বর কেষ্টরই। রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর উদ্দেশে দু’লাইনে কেষ্টর চিঠি, ‘আশা করি ভাল আছো। আমার প্রণাম নিও। সাম্প্রতিক ঘটনার জন্য আমি সামগ্রিক ভাবে সমস্ত স্তরের কাছে নিঃশর্ত ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।’ অনুব্রতের অডিয়ো ক্লিপ নিয়ে তৃণমূলের উপর চাপ বাড়াতে শুরু করেছে বিজেপি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অনুব্রতকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। ৯ জুন বোলপুরে অনুব্রতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচিরও ডাক দিয়েছে পদ্মশিবির। নরেন্দ্র মোদির অপারেশন সিঁদুরের সাফল্যের পর বাড়ির ‘মা ও স্ত্রীকে’ নিয়ে অশ্লীল গালিগালাজ করা এরকম একজন অশ্লীল মানুষতে গ্রেফতারের দাবিতে সরব প্রত্যেকেই।

এদিকে, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট পরবর্তী হিংসায় পাঁচ অভিযুক্তের জামিন খারিজ সুপ্রিম কোর্টের। কলকাতা হাই কোর্ট পাঁচ জনকে ২০২৩ সালে জামিন দিয়েছিল। সেই রায় খারিজ শীর্ষ আদালতের বিচারপতি বিক্রম নাথ এবং বিচারপতি সন্দীপ মেহতার বেঞ্চে। বীরভূম জেলার সদাইপুরের ওই ভোট পরবর্তী হিংসার ঘটনায় অভিযুক্তদের জামিন খারিজ করে দুই বিচারপতির বেঞ্চ পর্যবেক্ষণে বলেছে, ‘‘বিরোধী দলের উপর হামলা আদতে গণতন্ত্রের উপর হামলা।’’ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে ওই পাঁচ জনকে ট্রায়াল কোর্টে (নিম্ন আদালত) আত্মসমর্পণ করতে হবে। আত্মসমর্পণ না করলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবে ট্রায়াল কোর্ট। আগামী ছয় মাসের মধ্যে মামলার শুনানি (ট্রায়াল) নিম্ন আদালতকে শেষ করতে হবে বলেও জানিয়েছে বিচারপতি নাথ এবং বিচারপতি মেহতার বেঞ্চ। শীর্ষ আদালতের দুই বিচারপতির বেঞ্চ জানিয়েছে, ভয়মুক্ত পরিবেশে যাতে শুনামি হয় তা নিশ্চিত করতে হবে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব এবং পুলিশের ডিজিকে। প্রয়োজনে অভিযোগকারী এবং সাক্ষীদের নিরাপত্তা দিতে হবে পুলিশকে। ভোট পরবর্তী হিংসা মামলায় জামিন চেয়ে শেখ জামির হোসেন, শেখ নূরুই, শেখ আশরফ, শেখ কবিরুল এবং জয়ন্ত ডোম কলকাতা হাই কোর্টের দারস্থ হয়েছিলেন। হাই কোর্ট আবেদনে সাড়া দিয়ে জামিন মঞ্জুর করার পরে সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল সিবিআই। এই মামলায় সিবিআইয়ের আবেদন মেনে জানিন নাকচ করে শীর্ষ আদালতের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে, বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের উপর হামলা চালিয়েছেন অভিযুক্তরা। বিরোধীদের বাড়িঘর ভাঙচুর এবং মারধরের ঘটনায় জড়িত। ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের পরে রাজ্য জুড়ে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে’ খুন, ধর্ষণ এবং ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনাগুলিতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট। হাই কোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল রাজ্য সরকার। সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশই বহাল।