নতুন করে পরীক্ষায় বসতে হবে চাকরিহারাদের। সুপ্রিম কোর্ট চাকরি বাতিলের নির্দেশের সঙ্গেই জানিয়েছিল। সুপ্রিম নির্দেশ পালনে বাধ্য রাজ্য সরকার। ফের পরীক্ষায় বসতেই হবে চাকরিহারাদের। নবান্ন থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আন্দোলনরত শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এটা সরকারের নির্দেশ নয়। পরীক্ষা দেব না বলে তো কোনও লাভ নেই। আমরা চাই না একজনেরও চাকরি যাক।” মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ঘোষণাকে নিজেদের ‘মৃত্যুপরোয়ানা’ বলে মনে করছেন চাকরিহারা ‘যোগ্য’ শিক্ষকশিক্ষিকারা। সুপ্রিম কোর্ট আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চাকরি বহাল রেখেছে ‘যোগ্যদের’। স্কুলে ক্লাস করিয়ে, সংসার সামলে সাত বছর পর আবার নতুন করে পরীক্ষায় পাশ করার জন্য প্রস্তুতি কী ভাবে সম্ভব, প্রশ্ন চাকরিহারাদের প্রায় সকলেরই। চাকরিহারাদের পক্ষে আইনি লড়াই চালানোর পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশও মেনে চলতে হচ্ছে রাজ্য সরকারকে, এবং সেই নির্দেশ মতোই নতুন করে পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। আদেশ রাজ্য সরকারের। মুখ্যমন্ত্রীর মঙ্গলবারের ঘোষণা ২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় চাকরি পাওয়া এবং পরবর্তীতে চাকরি হারাদের জন্য আরও বড় জটিলতার সৃষ্টি করবে বলে মনে করা আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘উনি এই ঘোষণা করে আরও বড় জটিলতার মধ্যে ফেললেন। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, অযোগ্যদের চাকরি বাতিল করে তাঁদের থেকে টাকা ফেরত নিতে হবে। নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সেটাও সমান্তরাল ভাবে করার কথা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সে ব্যাপারে কিছু বলেননি। পাশাপাশি তিনি শূন্যপদে নিয়োগের কথা বলেছেন। এর ফলে ২০১৬ সালের চাকরিপ্রাপকেরা আরও বড় আইনি জটিলতায় পড়বেন বলেই আমার অভিমত’’
সুপ্রিম কোর্ট চাকরি বাতিলের নির্দেশের পরই নতুন করে পরীক্ষায় বসার কথা জানায় চাকরিহারাদের। বিষয়টাতে প্রথম থেকেই আপত্তি চাকরিহারাদের একাংশের। বারবার পরীক্ষায় বসতে রাজি না হওয়ার কথা জানায়। এই মর্মে একাধিকবার মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে চিঠিও দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “চাকরি বাতিলটা সরকারের অর্ডার নয়। আমরা সুপ্রিম কোর্টে কারও চাকরি যাওয়ার কথা বলিনি। কিছু স্বার্থপর মানুষ এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। পরীক্ষা দেব না বলে কোনও লাভ নেই। সবাইকে বলব, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী সব অপশন কাজে লাগান। আসল লক্ষ্য আমাদের চাকরি ফিরে পাওয়া।” সুপ্রিম নির্দেশ মেনে ৩০ মে এসএসসির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি হবে। সমান্তরালভাবে নজর থাকবে রিভিউ পিটিশনের দিকেও। কারও চাকরি যাতে না যায়, চাকরিহারারা যাতে সুযোগ পায় তার আবেদনও করা হয়েছে। প্রথম থেকেই চাকরিহারা ‘যোগ্য’ শিক্ষকশিক্ষিকাদের দাবি ছিল, তাঁরা আর পরীক্ষায় বসবেন না! পরীক্ষা না-দিয়ে কী ভাবে তাঁদের চাকরি বহাল থাকে তা দেখুক সরকার। কবে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে, কবে থেকে কবের মধ্যে আবেদন করা যাবে, কবে প্যানেল প্রকাশ বা কাউন্সেলিং সবিস্তারে জানান মুখ্যমন্ত্রী। চাকরিহারাদের দাবি, সরকার আরও কিছুটা হাতে সময় রেখে আবেদনের তারিখ ঘোষণা করতে পারত। চাকরিহারাদের আক্ষেপ, ‘‘নেতাজি ইনডোরে মুখ্যমন্ত্রী আমাদের চাকরি বাঁচানোর জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তাঁর কথা শুনে মনে হল উনি ওঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতিই রাখলেন না। পরীক্ষা দেওয়ার মানসিক অবস্থা নেই।কেন আবার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে? কোর্টও আমাদের সঙ্গে সুবিচার করেনি। সরকারও করল না। আশঙ্কা যা করেছিলাম, সেটাই সত্যি হল। আমরা চাইনি সরকার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করুক। কিন্তু আজ যে ভাবে বিস্তারিত বিজ্ঞপ্তির কথা জানানো হল, তা দেখে মনে হচ্ছে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না-করে পুনর্বিবেচনা আবেদনের দিকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারত সরকার। ‘মুখ্যমন্ত্রী মৃত্যুপরোয়ানা লিখে দিলেন’!’’

৩১ মে’র আগেই ৪৪ হাজার পদে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের কথা ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির। তালিকায় রয়েছে চাকরিহারা ২৪ হাজারের বেশি শিক্ষকের শূন্যপদ। এই পরীক্ষার জন্য আবেদন করা যাবে ১৬ জুন থেকে। শেষ তারিখ ১৪ জুলাই। প্যানেল পাবলিকেশন হবে ১৫ নভেম্বর। কাউন্সেলিং হবে ২০ নভেম্বর। ডিসেম্বরের মধ্যে আদালতের নির্দেশ মেনে হবে নিয়োগ। পাশাপাশি মমতা জানান, আবেদনকারীদের বয়সের বাধানিষেধ অনেকটা শিথিল করা হবে। সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পিটিশনের ফলাফলের দিকেও তাকিয়ে থাকবে রাজ্য। মমতা এদিন বলেন, ইচ্ছা না থাকলেও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানতে হচ্ছে। মমতা জানান, ‘মন থেকে নয়, বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে।’ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে হাজার হাজার চাকরি বাতিল হয়। সেই নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন শিক্ষকরা। সেই প্রেক্ষিতেই মু্খ্যমন্ত্রী এদিন বলেন, আদালতে দ্রুত রিভিউ পিটিশন করা হয়েছিল। বর্তমানে আদালতে চলছে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ। আদালত খোলার আগেই আগের রায় জানানোর নির্দিষ্ট দিন পেরিয়ে যাবে। সেই কারণেই ৩১ মে’র আগে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে। সেই জন্যই নতুন করে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে ৩০ মে। নতুন বিজ্ঞপ্তি অনুসারে ২৪,২০০ পদ থাকছে শিক্ষকদের জন্য। নবম দশমের জন্য ১১ হাজার ৫১৭ শিক্ষক পদ পূর্ণ করা হবে। একাদশ দ্বাদশের জন্য ৯,৫১২ শূন্যপদ থাকছে। এছাড়া গ্রুপ ডি’র জন্য অতিরিক্ত এক হাজার পদে নিয়োগ করা হবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পিটিশন সমানতালে জারি থাকবে। রাজ্যের পক্ষের আইনজীবীরা শিক্ষকদের হয়ে লড়াই করবেন। এর পাশাপাশি আদালতের রায় যদি পক্ষে না আসে তাহলে বা রিভিউ পিটিশনের ফলাফল অন্যরকম হলে চাকরি করার জন্য নতুন নিয়োগের পথ খোলা থাকবে। পাশাপাশি বয়সের ছাড় দেওয়াতে অনেকেই এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন। সেই কারণেই দুটো রাস্তা খুলে রাখা হচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডির চাকরিহারাদের অন্য বিভাগে নিয়োগে কোনও বাধা নেই। মমতা বলেন, গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডির যাদের চাকরি চলে গিয়েছে তাদের অন্য দফতরে নিয়োগ করবে রাজ্য সরকার। সেজন্য বেশ কয়েকটি দফতর নির্বাচন করা হয়েছে। চাকরিহারাদের অপশন দেওয়া হবে। সেখান থেকে তারা বেছে নিতে পারবেন। সব দফতরেই তো আমাদের লোক দরকার হয়। অনেক স্কুলে তো ঘণ্টা বাজানোর লোক নেই। ৩১ মে শিক্ষকদের নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারির পর আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে আমরা কয়েকদিনের মধ্যে এব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি জারি করব। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২০১৬ সালের প্যানেলের সমস্ত গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি কর্মচারীর চাকরি চলে গিয়েছেন। সপ্তাহ কয়েক আগেই তাদের জন্য ভাতা ঘোষণা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে ইতিমধ্যে মামলা দায়ের হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। এবার দুর্নীতির দায়ে চাকরিহারাদের পুনর্নিয়োগের ব্লু প্রিন্ট জানালেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে চাকরিহারা যোগ্যরা সন্দিগ্ধই।