শেষবেলার শতরান। দাম পেয়েছিলেন ২৭ কোটি। ঋষভ আইপিএলে রান করলেন ২৬৯! পন্থের প্রতি রানের দশ লক্ষ টাকা? চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির একটি ম্যাচেও ঋষভ পন্থকে খেলাননি ভারতীয় দলের কোচ গৌতম গম্ভীর। আইপিএলে সেই উপেক্ষা জবাব দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন পন্থ। টুর্নামেন্টের শেষ ম্যাচে জবাবদিহি? শতরান করে সমারসল্ট উচ্ছ্বাস। সোজা কথা ঋষভ পন্থের ডিগবাজি। ২৭ কোটি টাকা খরচ করে ঋষভ পন্থকে দলের জন্য নিয়ে সঞ্জীব গোয়েঙ্কা বলেছিলেন, “দিল্লি ক্যাপিটাল্স পন্থকে রাখবে না জানার পরই আমরা ওকে ধরে দল সাজানোর পরিকল্পনা করেছিলাম। আমার বিশ্বাস, পন্থ দারুণ নেতা। ওর সেরা নেতৃত্ব এখনও দেখতে পাইনি। আমরা ২৭ কোটিতে ওকে পেয়েছিলাম। দরকার হলে ২৮ কোটিও খরচ করতাম!”
আইপিএল শেষ হওয়ার পর লখনউ সুপার জায়ান্টসের মালিক গোয়েঙ্কার মাথায় একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে, এক কোটি তো বাঁচল! কারণ, ২৭ কোটি জলে গিয়েছে। ২০২৫ আইপিএলএ পন্থ ১৪ ম্যাচে মোট রান করেছেন ২৬৯। পন্থের প্রতিটি রানের জন্য গোয়েন্কা গুনেছেন প্রায় ১০ লাখ। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচের আগে এই হিসাব ছিল ১৮ লাখ! বিরাট কোহলির দলের বিরুদ্ধে ৬১ বলে ১১৮ রানের অপরাজিত ইনিংস শেষবেলায় ১১টি চার, ৮টি ছক্কার ইনিংসে মুখরক্ষা। শতরানের পর গ্লাভস, হেলমেট খুলে শূন্যে ডিগবাজি দিয় পন্থ, কী বোঝাতে চাইলেন মালিক সঞ্জীব গোয়েঙ্কাকে? দু’দিকে দু’হাত ডানার মতো ছড়িয়ে আকাশ পানে চেয়ে তৃপ্তির হাসিতেই ২৭ কোটির দেনা দায় থেকে চাপমুক্ত মনে করছিলেন। লখনউয়ের ভিআইপি বক্সে ছিলেন না গোয়েঙ্কাকে। আর থেকেই বা কি লাভ? এই ইনিংস দেখার জন্য খরচ করেছেন ২৭ কোটি। এই ইনিংস দেখার অপেক্ষা করেই গোটা আইপিএল কাটিয়ে দিয়েছেন। শেষবেলায় নিয়মরক্ষার ম্যাচ দেখতে আর লখনউ যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। ম্যাচের পরে সঞ্জীব গোয়েঙ্কা সমাজমাধ্যমে একটি শব্দ লিখেছেন ‘প্যান্টাস্টিক’!
আইপিএলের শুরু থেকেই পন্থ খারাপ ফর্মে। অথচ প্রতিটি ম্যাচে হারের পরে মাঠে নেমে হাসিমুখে দলের অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন গোয়েঙ্কা। ভিআইপি বক্সে বসে কয়েক বার বিরক্তি প্রকাশ। হাতে একটি ছবি নিয়ে, সম্ভবত ইষ্টদেবতা বা কুলদেবতা, বারবার কপালে ছোঁয়ানোর দৃশ্যও দেখা গেছে। ম্যাচের শেষে অধিনায়কের পিঠ চাপড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন এসজি। অন্তরে অস্বচ্ছন্দ বোধ করেছেন? উপায় নেই। গোয়েঙ্কা তাড়া করেছে লোকেশ রাহুলের অভিশপ্ত দিনের কথা। গত মরশুমে রাহুল ছিলেন লখনউয়ের অধিনায়ক। একটি ম্যাচ হারার পরে মাঠে নেমে প্রকাশ্যেই রাহুলকে ভর্ৎসনা করেছিলেন দলের মালিক। শোনা যায়নি কী বলেছিলেন। কিন্তু দেশের অন্যতম সফল ব্যবসায়ীর ভঙ্গিতে বোঝা গিয়েছিল, স্নেহ নেই। আইপিএলে দল কিনে প্রচুর বিনিয়োগ। প্রত্যাশামতো ফল না-পেলে ক্ষুব্ধ হওয়াটাই প্রত্যাশিত। সর্বসমক্ষে মেজাজ হারানো, সম্ভবত ভুল ছিল। প্রকাশ্যেই সমালোচিত হয়েছিলেন লখনউ দলের মালিক। গোয়েঙ্কা ও রাহুলের বাগবিতণ্ডা ক্রিকেটহমহল ও সমাজমাধ্যমেও ভাইরাল। পরে রাহুলকে বাড়িতে নৈশভোজে ডেকে মলমের প্রলেপ দিয়ে গোয়েঙ্কা বোঝাতে চেয়েছিলন মধুরেণ সমাপয়েৎ। কিন্তূ না! ব্যবসায়ী মানুষ। খেলাটাও বোঝেন। কীভাবে খেলতে হয়।
কম যান না ক্রিকেটারও। লোকেশ রাহুল লখনউকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন দিল্লিতে। গোয়েঙ্কা পরবর্তী নেতা বেছে নিলেন পন্থকে। দরাজ শংসাপত্র দিয়ে অধিনায়ক পন্থকে ডান দিকে ও বামদিকে লখনউয়ের কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে বসিয়ে গোয়েঙ্কা বলেছিলেন, “আমাদের এমন একজন নেতা দরকার, যে নিজের দক্ষতায় বিশ্বাস করে। যে ভয়ডরহীন এবং বিধ্বংসী ব্যাটিং করতে পারে। ঋষভের মধ্যে সবই রয়েছে। পন্থকে না পেলে লখনউ দলে এমন কোনও ভারতীয় ব্যাটার থাকত না, যে ইনিংস টানতে পারবে। এমন এক জন, যাকে ঘিরে পুরো দল তৈরি হবে।” টুর্নামেন্টে বিশ্বাস আর বাস্তবের দূরত্ব কারুর অজানা নয়। বিধ্বংসী ব্যাটিং তো দূরস্থান। মঙ্গলে বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলতে নামার আগে পর্যন্ত ১৩টি ম্যাচে পন্থের মোট রান ছিল ১৫১। সাত বার তিনি দু’অঙ্কেও পৌঁছতে পারেননি। ব্যাট করতে নেমে দ্বিধায় ভুগে শট নির্বাচন করতে পারেননি। বলের লাইনে গিয়ে খেলতে পারেননি। সাধারণ ডেলিভারিতে উইকেট ছুড়ে দিয়ে এসেছেন। উইকেটরক্ষক হিসাবেও ক্যাচ ফেলেছেন। সহজ স্টাম্পিংয়ের সুযোগ ফস্কেছেন। ধরেছেন পাঁচটি ক্যাচ। স্টাম্প আউট একটি। পন্থকে দেখে মনে হয়েছে, আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগেছেন। ব্যাটে রান নেই। পারফরম্যান্স তলানিতে। আইপিএল থেকে বিদায়ের মূহুর্তে ফিরে আসছে রান পিছু দশ লাখ খরচের কথা।
লোকেশ রাহুলের দিল্লির বিরুদ্ধে দু’টি ম্যাচই হেরেছে গো্য়েঙ্কা-পন্থের লখনউ। প্রথম ম্যাচে দিল্লি জিতেছিল এক উইকেটে। পন্থ করেছিলেন ৬ বলে শূন্য! সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য রাহুল সেই ম্যাচে খেলেননি। পরেরটিতে দিল্লি জিতেছিল আট উইকেটে। পন্থ করেছিলেন ২ বলে শূন্য। রাহুল সেই ম্যাচে করেছিলেন ৪২ বলে ৫৭ রান। দিল্লির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার দু’টি ম্যাচে ব্যাটে পন্থের অবদান শূন্য। পক্ষান্তরে লখনউয়ের বিরুদ্ধে ছক্কা মেরে ম্যাচ জিতিয়ে ‘প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ’ হয়েছিলেন রাহুলই। পন্থের দুঃস্বপ্নের মরসুম। শতরানে শেষ। আর ২০২৫ আইপিএল এর শেষ ম্যাচে কোহলিদের বিরুদ্ধে মাঠেই ডিগবাজি খেলেন লখনউয়ের অধিনায়ক। পন্থ নিজেই খুন করলেন আশায় থাকা লখনউ কর্তৃপক্ষকে। আশাহত ক্রিকেটপ্রেমীরাও। আইপিএলের আগে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির একটি ম্যাচেও পন্থকে খেলাননি ভারতীয় দলের কোচ গৌতম গম্ভীর। ভারতের প্রথম একাদশে জায়গা হারানো পন্থ আইপিএলে জবাব দেওয়ার পরিবর্তে পন্থ নিজেকেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন জবাবদিহির পরিস্থিতিতে।
সংযত গোয়েঙ্কা। নীরব গোয়েঙ্কা। ক্যামেরার সামনে অধিনায়কের সঙ্গে লুকোনো হাসি হেসে বাক্যালাপ। লোক দেখানো গল্প-সল্পও ক্যামেরার সামনে। কারণ, সঞ্জীব হলেন সংশোধিত মালিক। রাহুলের সময়ে করা ভুলের পুনরাবৃত্তি আর করতে চাননি গোয়েঙ্কা। পন্থ কিন্তু একবারের জন্যও নিজেকে সংশোধন করতে চেয়েছেন বলে মনে হয়নি? টানা ব্যর্থতা। খেলায় পরিবর্তনের চেষ্টাই ছিল না। বার বার দলের ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তন। অথচ নিজেকে প্রথম একাদশের বাইরে রাখার কথা ভাবেননি। কোনও ম্যাচে ওপেন করেছেন। কোনও ম্যাচে নিজের নির্দিষ্ট জায়গা চার নম্বরে নেমেছেন। কোনও ম্যাচে ব্যাটিং অর্ডারে নিজেকে পিছিয়ে দিতে দিতে নিয়ে গিয়েছেন সাত নম্বরে! রানের খোঁজে নিরন্তর পরীক্ষা। বার বার কৌশল বদলে। তবু সাফল্য নেই। উপরন্তু লখনউ প্লে-অফের দৌড় থেকে ছিটকে যাওয়ার পর পন্থ দায়ী করেছেন বোলারদের চোট-আঘাতকে। অজুহাত বলতে, বোলারদের ধারাবাহিকতার অভাবের কথা। নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে কোনও কথা বা আত্মসমালোচনার বালাই নেই। পন্থের বেহাল দশা। ক্রিকেটের বামন দেশ আইসল্যান্ডের কাছ থেকেও দলের সঙ্গে ‘প্রতারণা’ (মোটা টাকা পেয়েও খারাপ খেলা) করা ক্রিকেটারদের একাদশের অধিনায়ক! শুনতে হয়েছে পন্থকে।
একটি মরশুমের ব্যর্থতাতেই পন্থকে একেবারে ছেঁটে ফেলার পথে ধুরন্ধর ব্যবসাবুদ্ধি সম্পন্ন গোয়েঙ্কা হাঁটবেন বলে মনে হয় কী? সাফল্য দিতে না পারায় অধিনায়ক রাহুলকে রাখেননি গোয়েঙ্কা। পন্থের ভবিষ্যৎ? আইপিএলের মধ্যেই জল্পনা আগামী বছর লখনউ কর্তৃপক্ষ ছেঁটে ফেলবেন পন্থকে। ইংল্যান্ড সফরের ভারতের দলের সহ-অধিনায়কের কাছে ‘‘সব ভিত্তিহীন খবর!’’ শেষবেলার সেঞ্চুরি অনেকটা শেষবেলার স্মৃতির মতোই টাটকা। পন্থের উত্তরণ? পন্থের বিকল্প ভারতীয় ক্রিকেটার পেতে খোঁজ শুরু করতে হবে গোয়েঙ্কাকে। লখনউয়ের বিদেশি ক্রিকেটারের কোটা শেষ। অন্য কোনও দল তাদের ভারতীয় ক্রিকেটারকে ছাড়বে না। শেষ ম্যাচে অধিনায়কোচিত পারফরম্যান্স দিতেও পারে পরের মরশুমের প্রত্যাবর্তনের বার্তা। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মুখ থেকে অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে ঋষভ পন্থ জানিয়ে দিয়েছিলেন ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’!