খোলা চুলে মাঝামাঝি চওড়া সিঁথি কেটে সিঁথিতে সিঁদুর। গলায় লাল চুনির মালা। দুধ সাদা বেনারসি। কানের লাল গালিচা ঐশ্বর্যে ভরা! শাড়ি পরে ঐশ্বর্য। ২০০২ সাল থেকে কান চলচ্চিত্র উৎসবে। প্রথম বছর কানে শাড়ি পরেছিলেন অভিনেত্রী। ২৩ বছর পরে আবার কানে পরিহিত শাড়িতে। ঐশ্বর্য এসেছিলেন ‘দ্য হিস্ট্রি অফ সাউন্ড’ ছবির প্রিমিয়ারে। কান চলচ্চিত্র উৎসবের লাল গালিচায় ঐশ্বর্যা রাই বচ্চন। ঐশ্বর্য আবির্ভূত হলেন কানের অজস্র ভারতীয় শৌখিনী এবং তারকাদের ভিড়ে। লাল গালিচায় আসতেই অভিনেত্রীকে দেখে ঝলসে উঠল ক্যামেরার ফ্লাশবাল্ব। সাদা বেনারসির সঙ্গে ৫০০ ক্যারেটের মোজাম্বিকে চুনির মালা এবং একটি বড় হিরের গয়না পরেছিলেন ঐশ্বর্য। আঙুলে ছিল চুনি এবং হীরের বড় আংটি। সোনা এবং রুপোর জরি দিয়ে কড়ওয়া পদ্ধতিতে হাতে বোনা হয়েছে ঐশ্বর্যার বেনারসি শাড়িটি।

ঐশ্বর্যার শাড়িটি তৈরি করেছেন বলিউডের পোশাকশিল্পী মণীশ মালহোত্র। শাড়িটি হাতে বোনা কড়ওয়া বেনারসি শাড়ি। কড়ওয়া বুনন হল বেনারসির সবচেয়ে কঠিন বুনন পদ্ধতি। বেনারসির নাম ‘কড়ওয়া’। হিন্দিতে কড়ওয়া শব্দের অর্থাৎ কড়া বা কঠিন। বুনন পদ্ধতিটি কঠিন। এর প্রতিটি বুটি আলাদা আলাদা ভাবে বোনা হয় হাতে। এই বেনারসি বুনতে সময় এবং পরিশ্রম লাগে অনেক বেশি। কাজও হয় অনেক সূক্ষ্ম। কানে ঐশ্বর্যার শাড়ির ছবি দিয়ে মণীশ লিখেছেন শাড়িটিতে রুপো এবং রোজ় গোল্ডের জড়ি ব্যবহার করে বোনা হয়েছে এক একটি বুটি। তার উপরে সোনা রুপোর জরি দিয়ে বুনে করা হয়েছে সূক্ষ্ম জারদৌসি কাজ। শাড়িতে নাটকীয়তা আনার জন্য ওর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে একটি দুধ সাদা স্বচ্ছ টিস্যুর ওড়না। সোনা-রুপোর জরির নকশা দিয়ে পাড় বোনা। নজর কেড়ে নিয়েছে ঐশ্বর্যের সিঁদুর! সাজের অঙ্গ। ভারতীয় সংস্কৃতিতে সিঁদুর বিবাহিত নারী। ঐশ্বর্যার বিবাহিত জীবনে অশান্তি নিয়ে আলোচনা, আন্তর্জাতিক মঞ্চে সিঁদুর পরে আগমনকে বিশেষ বার্তা। আন্তর্জাতিক মঞ্চে সিঁদুর পরে ঐশ্বর্যার আগমনের নেপথ্যে দেশভক্তি। ভারতে হওয়া পহেলগামের জঙ্গি হামলা এবং তার জবাবে ‘অপারেশন সিঁদুর’ – এর সমর্থনেই সিঁথিতে সিঁদুর পরেছেন ঐশ্বর্যা। যেমন কানে সিঁদুর পরতে দেখা গিয়েছে বলিউডের আরেক নায়িকা অদিতি রাও হায়দরিকেও।

এর আগেও কান চলচ্চিত্র উৎসবে লাল শাড়ি, লাল টিপ পরে খাঁটি ‘ভারতীয় নারী’ অদিতি রাও হায়দরি এসেছিলেন! নববধূর মতো সাজ কান চলচ্চিত্র উৎসবে। লাল শাড়ি, লাল টিপ আর মাথা ভর্তি সিঁদুর পরে কানের রাস্তায় অদিতি রাও হায়দরি। কান চলচ্চিত্রোৎসবের লাল গালিচায় দেশ বিদেশের তারকারা আসেন। আসেন ভারতীয় সিনেমা জগতের তারকারাও। চলচ্চিত্রোৎসব হলেও নজর তারকাদের ফ্যাশনে। বিগত কানে ভারতীয় অভিনেতা অভিনেত্রীরা পোশাকে ফ্যাশন অধিকাংশেই পাশ্চাত্য অনুপ্রাণিত গাউন। ভারতীয় ঘরানার পোশাক পরলেও তাতে নানা রকমের বিদেশি ভাবনাকে জুড়েছেন। কান চলচিত্রোৎসবে হাল আমলের বলিউডের নায়িকারা শাড়ি-ব্লাউজ পরলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ শাড়ি-ব্লাউজের মতো পরেননি। কানে অদিতি পরেছিলেন ভারতীয় ব্র্যান্ড ‘র ম্যাঙ্গো’র লাল রঙের সিল্কের শাড়ি প্রায় নকশাহীন। টম্যাটো লাল রঙের শাড়িতে নীল ফিতে পাড়। সোনালি সুতোর বুনন পাড়ের উপরে এবং আঁচলে। অদিতির পরনে লাল রঙের স্লিভলেস ব্লাউজ়। গলায় রঙিন কুন্দনের চোকার। গয়না আর পোশাক। অদিতির সাজে নজর কেড়েছে সিঁথির চওড়া সিঁদুরের দাগ। মাথায় আলগা হাতখোঁপা নায়িকার। কপালে লাল টিপ। ঠেঁটে হালকা গোলাপি আভার লালচে লিপস্টিক। নববধূর সাজে। কানে সমুদ্রের নীল জলের সামনে দাঁড়িয়ে ফটো পোজে অদিতি। কানের রেড কার্পেটে আবার সমূদ্রতীরের শহরে সৈকতে দাঁড়িয়েও ছবিতে অদিতি।

কান উৎসবে মহারানী সাজে জাহ্নবী। শ্রীদেবী কন্যা জাহ্নবী কাপুর। ‘হোমবাউন্ড’ টিমের সঙ্গে রেড কার্পেটে হাঁটলেন। অভিনেত্রীকে সঙ্গ দিলেন ঈশান খট্টর এবং পরিচালক নীরজ ঘায়ওয়ান। রেড কার্পেটে তরুণ তাহিলিয়ানির পোশাকে নিজেকে সাজিয়ে ছিলেন অভিনেত্রী। গোলাপি রঙের লেহেঙ্গা, মাথায় ঘোমটা, মানানসই পার্লের গয়না, সব মিলিয়ে যেন মনে হচ্ছিল কোন মহারানী হেঁটে যাচ্ছেন রেড কার্পেট দিয়ে। নজর কেড়েছে অভিনেত্রীর হাতের কালো কার। নজর কেড়েছে হাতের কালো সুতো। কান চলচ্চিত্র উৎসবে আসার আগে কুনজর থেকে বাঁচাতেই বিশেষ টোটকা অবলম্বন। ইশান খট্টর, বিশাল জেঠওয়া এবং জাহ্নবী কাপুর অভিনয় করেছেন নীরজ পরিচালিত হোমবাউন্ডে, যা কানে প্রিমিয়ার। মার্টিন স্করসেসি ছবিটির নির্বাহী প্রযোজক হিসাবে বোর্ডে এসেছেন। কান চলচ্চিত্র উৎসবের ‘আন সার্টেন রিগার্ড’ বিভাগে দেখানো হবে ‘হোমবাউন্ড’। ছবিটি প্রযোজনা করেছেন করণ জোহর, আদর পুনাওয়ালা, অপূর্ব মেহতা এবং সোমেন মিশ্র। সহ-প্রযোজক হলেন মারিজকে ডি সুজা এবং মেলিটা টসকান ডু প্লান্টিয়ার। এই বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে নজর কেড়েছেন রুচি গুজ্জর প্রধানমন্ত্রীর ছবি আঁকা নেকলেস পরে এসেছেন। বগল ছেঁড়া পোশাক পরে উপহাসের সম্মুখীন উর্বশী। বেশি নজর কেড়েছেন শর্মিলা এবং সিমি। ফুলকুমারী সেজে কান চলচ্চিত্র উৎসবে নজর কেড়েছেন নীতাংশী গোয়েল, চুলে ঝুলিয়ে দিয়েছেলেন ৮ কিংবদন্তি অভিনেত্রী ছবি।

সবুজ শাড়িতে শর্মিলা ঠাকুর। শ্বেতশুভ্র সিমি। মুগ্ধ দর্শকরাও। মুক্তির ৫৫ বছর পর ফের বড় পর্দায় অরণ্যের দিনরাত্রি কান চলচ্চিত্র উৎসবে। ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসব আলোকিত করেন সিমি গারেওয়াল এবং শর্মিলা ঠাকুর। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত অরণ্যের দিনরাত্রি প্রদর্শনী। দুই ভারতীয় তারকা উপস্থিতি আরও একবার মনে করিয়ে দিল ভারতীয় ঐতিহ্যের কথা। কান চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য শর্মিলা ঠাকুর বেছে নিয়েছিলেন একটি সোনালী পাড়ের সবুজ রঙের শাড়ি, সিমি সাদা পোশাকে সাজিয়েছিলেন নিজেকে। দুই তারকার সঙ্গী হয়েছিলেন সত্যজিৎ অনুরাগী আমেরিকান পরিচালক ওয়েস অ্যান্ডারসন। ১৯৭০ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, শমিত ভঞ্জ, অপর্ণা সেন, শর্মিলা ঠাকুর, কাবেরী বসু ও সিমি গারেওয়াল অভিনয় করেছিলেন এই সিনেমায়। সিনেমাটি ২০ তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্রের জন্য গোল্ডেন বিয়ারের পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিল। কান চলচ্চিত্র উৎসবে এর আগেও আন্তর্জাতিক পর্দায় প্রদর্শিত হয়েছিল অরণ্যের দিনরাত্রি। প্যারিস এবং নিউইয়র্কের একাধিক প্রেক্ষাগৃহে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এই ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন একাধিক বিদেশী দর্শক।

ফ্যাশনকে অস্ত্র করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানকে কড়া বার্তা সোনম ছাবড়ার। পুলওয়ামা, পহেলগাঁওয়ের ‘সন্ত্রাস-ক্ষত’ নিয়ে কান-এ সোনম। বিশ্বমঞ্চে দিলেন ঐক্যবদ্ধ ভারতের বার্তা। মুম্বই হামলা, উড়ি, পুলওয়ামা, পহেলগাঁও। ভারতে একের পর এক সন্ত্রাস হামলার অভিযোগের তীর প্রতিবেশী পাকিস্তানের দিকে। সাম্প্রতিক কাশ্মীরের বৈসরণ উপত্যকায় হওয়া ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনায় দেশবাসী বরাবর ঐক্যবদ্ধ। পোশাকেও ‘একতার মন্ত্র’ এ কান-এর কার্পেটে বাজিমাত সোনম ছাবড়ার। ফ্যাশনকে অস্ত্র করেই আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানের উদ্দেশে দিলেন কড়া বার্তা। পরনে অফশোল্ডার সাদা গাউন। শিমারি ব্রালেট থেকে উঁকি দিচ্ছে রূপযৌবন। সন্ত্রাস হানার তারিখগুলি জ্বলজ্বল করছে ক্রমানুসারে। কান-এর মঞ্চে মডেল-অভিনেত্রী স্মরণ করিয়ে দেন ২৬/১১-র মুম্বই হামলার কথা, ২০১৬ সালে হওয়া উরি হামলার কথা। উসকে দিলেন ২০১৯ সালের পুলওয়ামার বিষাক্ত স্মৃতি। সোনামের সাদা গাউনজুড়ে শুধুই ক্ষতের দিনক্ষণ। পোশাকে লেখা ‘অটুট’ শব্দ। বলিউডের এই মডেল-অভিনেত্রী সোনম ছাবড়ার পোশাক চর্চার বিষয় ফ্যাশন দুনিয়ায় প্রশংসা কুড়িয়েছেন পশ্চিমী দেশেও। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের রেড কার্পেটে ভারতীয় বিনোদুনিয়ার একাধিক শিল্পীর তালিকায় যেমন শাহরুখ খান, অনুপম খের, শর্মিলা ঠাকুর, সিমি গরিওয়ালের মতো তাবড় মুখ। জাহ্নবী কাপুর, করণ জোহর, বীর পাহাড়িয়া, ইশান খট্টর, উর্বশী রাওতেলা, ন্যান্সি ত্যাগীরাএ অনুষ্ঠানের অন্তিম লগ্নে হাজির আন্তর্জাতিক মঞ্চে।

১৩ই মে থেকে শুরু ৭৮ তম কান চলচ্চিত্র উৎসব। বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ এই চলচ্চিত্র উৎসবে সামনে আসে বিশ্ব চলচ্চিত্রের নানা রং, তবে এবারের কান ফিল্ম ফেস্টিভাল ভারতীয় ছবির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। জনপ্রিয় তারকাদের থেকে শুরু করে নতুন প্রতিভাদের ডেবিউ পর্যন্ত কানের স্পটলাইট পেয়েছে নানান ছবি। একদিকে রয়েছে যেমন পুরোনো ক্লাসিক ছবি তেমন অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের নতুন ধারার ছবিও। পাঁচটি ভারতীয় ছবি এবারের কান-এ প্রদর্শিত হয়েছে সেগুলি হল ” অরণ্যের দিনরাত্রি” ,” তনভি দ্য গ্রেট ”, ”হোমবাউন্ড”, ”চড়ক”, ”আ ডল মেড আপ অফ ক্লে”। ১৯৭০ সালে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চলচ্চিত্র অরণ্যের দিনরাত্রির ৪কে রিস্টোরেশন ভার্সন কান-এ প্রদর্শিত ছবির তালিকায়। চার বন্ধুকে নিয়ে নির্মিত ছবিতে শহুরে জীবন থেকে ছুটি পেতে সম্মুখীন হয় গ্রামীণ জীবনের নানা পরিস্থিতির কথা। কানের এই বিশেষ প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং শর্মিলা ঠাকুর। ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, ক্রিটেরিয়ান কালেকশন ও ওয়ার্ল্ড সিনেমা প্রজেক্টের সহযোগিতায় রিস্টোর এই ছবিটিতে। তনভি দ্য গ্রেট ছবির পরিচালকের আসনে অনুপম খের, তনভি দ্য গ্রেট এখনও মুক্তি না পেলেও ১৭ ই মে কান-এ প্রদর্শিত। বোমান ইরানি, জ্যাকি শ্রফ, অরবিন্দ স্বামী সহ একাধিক জনপ্রিয় অভিনেতা এই চলচ্চিত্রে। নীরাজ ঘেওয়ান পরিচালিত ”হোমবাউন্ড” , কান-এ প্রদর্শিত হয়েছে আন সার্টেন রিগার্ড বিভাগে। ঈশান খাট্টার, জাহ্নবী কাপুর ও বিশাল জেঠওয়া অভিনীত ছবিটি উত্তর ভারতের ছোট এলাকায় বড়ো হয়ে ওঠা দুই বন্ধুর স্বপ্নের গল্প বলে, নানা সমস্যার মধ্যে দিয়ে পরীক্ষিত হতে থাকে সম্পর্কের গভীরতা। কান-এ চলচ্চিত্র উৎসব এ ছিল বাংলা ছবি ”চড়ক”, শিলাদিত্য মৌলিক নির্মিত এই ছবি চড়ক পুজোর বিশ্বাস, সংস্কার ও অন্ধত্বকে তুলে ধরেছে। বাংলার এই প্রাচীন প্রথা ও সংস্কৃতিকে নিয়ে তৈরী চলচ্চিত্র গ্লোবাল মঞ্চে কুড়িয়েছে প্রশংসা। আ ডল মেড আপ অফ ক্লে কলকাতার সত্যজিৎ রায় ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট এর ছাত্রী কোকোব গেব্রেওয়েরিয়া তসফে পরিচালিত ও সাহিল মনোজ ইংলে প্রযোজিত এই স্বল্প দৈর্ঘের ছবি আ ডল মেড আপ অফ ক্লে, জায়গা করে নিয়েছে লা সিনেফ বিভাগে। এটি মূলত কান-এ ছাত্র ছাত্রীদের প্রতিভা আত্মপ্রকাশের বিভাগ। ছবিটিও যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছে এর অভিনব ভাবনার কারণে।