১৫ মে বিকাশ ভবনের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষকদের বেধড়ক মার। কখনও লাঠি, কখনও হেলমেট দিয়ে মারার অভিযোগ। একাধিক শিক্ষকের মাথা ফেটেছে, কারও পায়ে লেগেছে। ঘটনার নিন্দায় সরব সচেতন মহল। অভিনেতা ঋদ্ধি সেন তীব্র সমালোচনা করেন। তৃণমূল কংগ্রেস এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একহাত নেন। ঋদ্ধি পোস্টে চাকরিহারা শিক্ষকদের মারার বিরোধিতা করতে গিয়ে সদ্য উদ্বোধন করা দিঘার জগন্নাথ ধামের বিরোধিতা করেন। কটাক্ষ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর কবিতা লেখা, গান গাওয়াকে। ঋদ্ধি পোস্টে লেখেন, ‘চোর, গুন্ডা এবং পদলেহনকারী তারকাদের জন্য আছে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সহিষ্ণুতা আর চাকরিহারাদের জন্য আছে পুলিশের নৃশংস আগ্রাসন, লাঠির বাড়ি। চাকরিহীন রাজ্যে জগন্নাথ ধাম বানিয়ে সেটা উদ্বোধন করতে যাওয়ার সময়ে আছে। বিজয়া সম্মিলনী,পুজো কার্নিভাল করার সময় আছে। রাতে বাংলা মেগা সিরিয়াল দেখার সময় আছে। চলচ্চিত্র উৎসবে মুম্বইয়ের তারকাদের সাথে দেখা করার সময় আছে। বেসুরো গান গাওয়ার, মৃত শব্দের কবিতা লেখার আর সুবিধেবাদীতার রঙে ছবি আঁকার সময় আছে। স্বাস্থ্য কেন্দ্র হোক, শিক্ষা ব্যবস্থা বা বাংলা চলচ্চিত্রের সিনে ফেডারেশন, সমস্ত কর্মক্ষেত্রের শীর্ষ স্থানে চোর এবং গুন্ডাদের প্লেসমেন্ট দিয়ে তোলাবাজ রাজনীতির মার্ক শিট মনিটর করার সময় আছে। রাজ্যে শিক্ষার ভবিষ্যৎকে অতীত করে দিয়ে ডিলিট সম্মান নিতে যাওয়ার সময় আছে। টেলিসম্মান পুরস্কার বা মহানায়ক উত্তম কুমার পুরস্কার দিতে যাওয়ার সময় এবং ইচ্ছে আছে, শুধু রাজ্যের নাগরিকদের চাকরি কেড়ে নিয়ে তাদের রাগ, যন্ত্রণা এবং হতাশা বোঝার, দেখার আর শোনার সময় নেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর। ধিক্কার মমতা বন্দোপাধ্যায়, তৃণমূল কংগ্রেস, কলকাতা পুলিশ। আপনারা ভীত কারণ আপনাদের পতনের সময় আসন্ন।’
রাতভর দফায় দফায় লাঠিপেটা করার পর বিধাননগরের বিকাশ ভবনের সামনে চাকরিহারা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করল পুলিশ। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা ও সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুরের অভিযোগ আনা হয়েছে। ধিক্কার দিবসে বিকাশ ভবনের সামনে ব্যারিকেড তৈরি করে আন্দোলনরত শিক্ষকদের রোখার চেষ্টা করে পুলিশ। শিক্ষকরা সেই ব্যারিকেড তুলে সরিয়ে ফেলেন। এর পর বিকাশ ভবনের সামনে ধরনায় বসে। শিক্ষকদের একটাই দাবি, যোগ্যদের চাকরি ফেরাতে হবে সরকারকে। চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকদের বিকাশ ভবন অভিযানে নির্বিচারে লাঠি চালায় পুলিশ। পুলিশের লাঠিতে একাধিক শিক্ষকের পা ভেঙেছে, মাথা ফেটেছে। আহত হয়েছেন বহু। রাতভর পুলিশের এই বর্বরতার পর শুক্রবার সকালে বিকাশ ভবনের সামনে আরও বাড়ানো হয় পুলিশের সংখ্যা। আন্দোলনকারীদের এক নেতা জানিয়েছেন, আমরা আমাদের হকের চাকরি ফেরানোর দাবিতে আন্দোলন করতে নেমে পুলিশের লাঠি খেয়েছি। পুলিশ আবার মারলে আবার মার খাব। কিন্তু এখান থেকে সরব না। এখানে মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী এসে আমাদের কথা বলুন। আন্দোলনকারীদের সাফ কথা, পুলিশ আমাদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে এখন আমাদের বিরুদ্ধেই মামলা করছে? এই পুলিশকে ধিক্কার। বিধাননগর পুলিশ এক আধিকারিক বলেন, ‘গতকাল বিকাশ ভবনের গেট ভাঙা হয়েছে। বিকাশ ভবনের কর্মচারীরা আটকে পড়েছিলেন। আমাদের বরিষ্ঠ আধিকারিকরা এসে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে বিকাশ ভবনের কর্মীদের বাড়ি যেতে দিতে বলেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা তাতে রাজি ছিলেন না। ফলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমানুপাতিক হারে আমাদের পদক্ষেপ করতে হয়েছে।’
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও গরম হয়েছে আবহ। সূর্যের তাপের মতোই তপ্ত হয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। তারপর দিয়েছেন ডাক। তাদের সঙ্গে যে ‘নির্মম অত্যাচার’ চলছে সেই কথা বলে, রাজ্যের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিশেষ করে বিরোধী দলনেতাকে পাশে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছে বিক্ষোভরত চাকরিহারারা। আন্দোলনস্থল থেকেই সাংবাদিকদের চাকরিহারা বিক্ষোভকারী সুমন বিশ্বাস জানিয়েছেন, ‘যৌথ সিদ্ধান্তে আমরা সর্বস্তরের মানুষ, সব দলকে স্বাগত জানাচ্ছি। আমাদের আর্জি, আপনারা পাশে এসে দাঁড়ান। আমাদের চাকরি ফেরানোর ব্যবস্থা করুন। আমরা কাউকে গো-ব্যাক দেব না। সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল যারাই আসবেন, তারা নিজেদের আদর্শ, দলীয় পতাকা ছাড়া আসুন।’ অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ। বিকাশ ভবনে চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের অভিযান ঘিরে উত্তাল পরিস্থিতি। বৃহস্পতিবার দুপুরে আন্দোলনকারীরা বিকাশ ভবনের গেট ভেঙে ফেলে ভিতরে ঢুকে যায়। রাতে আরও উত্তেজনা বাড়ে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আন্দোলনকারীদের। শিক্ষকদের মারধোরের অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। এবার বিধাননগর পুলিশের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে স্বতঃ প্রণোদিত মামলা করা হল। ২০১৬ সালে এসএলএসটি যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা দায়ের করেছে বিধাননগর পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধা দেওয়া এবং অবৈধভাবে সরকারি কর্মীদের অভিযোগ আনা হয়েছে। একাধিক ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশের এই পদক্ষেপকে ধিক্কার জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। তাদের বক্তব্য, “আমরা কোনও ভাঙচুর করিনি। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলাম। পুলিশ কয়েকটা ছবি নিয়ে এখন আন্দোলনকে বিমুখ করার চেষ্টা করছে। এভাবে আমাদের আটকাতে পারবে না। আমাদের হকের চাকরি ফিরিয়ে দিতেই হবে।”
বিকাশ ভবনের সামনে খোয়া যাওয়া চাকরি সসম্মানে ফেরত পেতে আন্দোলনে লাগাতার। চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকারা, অন্য কোনও সরকারি ছেড়ে স্কুলের চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন, এবং এসএসসি-র ২০১৬ সালের প্যানেলভুক্ত হয়ে স্কুলে চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁদের একটা বড় অংশই ফিরে যেতে চাইছেন পুরোনো চাকরিতে। পুরোনো চাকরিতে ফেরার আবেদন জানিয়ে রাজ্য শিক্ষা দফতরের দ্বারস্থ হয়েছেন অন্য চাকরি ছেড়ে স্কুলে চাকরি করতে আসা এবং বর্তমানে চাকরিহারা ওই শিক্ষক শিক্ষিকা বা শিক্ষাকর্মীরা। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এখনও পর্যন্ত এমন অন্তত ৪০০ আবেদন জমা পড়েছে। এই সংখ্যা আগামী দিনে আরও বাড়তে পারে। শিক্ষা দফতর সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, প্রত্যেকটি আবেদনই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আবেদনকারীরা স্কুলের চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে কে, কোথায় চাকরি করতেন, তা যাচাই করা হচ্ছে। এই আবেদনকারীদের মধ্যে একটা অংশ আবার আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। পরে তাঁরা মাধ্যমিক তথা উচ্চমাধ্যমিকস্তরের স্কুলে যোগ দেন। শোনা যাচ্ছে, চাকরি হারিয়ে এঁরা সকলেই এবার প্রাইমারি স্কুলের পুরোনো চাকরিতে ফিরে যাওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট যখন এসএসসি-র ২০১৬ সালের প্রায় সম্পূর্ণ প্যানেল বাতিল করে দিয়েছিল, সেই সময় আদালত জানিয়েছিল, যাঁরা অন্য কোনও রাজ্য সরকারি দফতরের চাকরি ছেড়ে স্কুলের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা চাইলে তাঁদের পুরোনো অফিসে বা কাজে ফেরত যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনমাসের মধ্যে তাঁদের পুরোনো চাকরিতে ফের বহাল করতে হবে। কোনও সার্ভিস ব্রেক হবে না। আদালতের এই নির্দেশ মাথায় রেখেই চাকরিহারাদের একাংশ আন্দোলনের পথে না হেঁটে পুরোনো চাকরি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন। চাকরি বাতিলের ফলে পুরো পরিবারকে পথে বসতে না হয়।