নৃশংস পাক বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েও জীবিত অবস্থায়, এমনকী সুস্থ শরীরে দেশে ফিরেছেন। অন্যদিকে একাধিক ভারতীয় জওয়ানের দেহ ফিরে এসেছে নির্মম অত্যাচারের চিহ্ন নিয়ে। কার্গিল যুদ্ধের সময় পাক সেনার নির্মম নির্যাতনের শিকার হন স্কোয়াড্রন লিডার অজয় আহুজা। তবে বর্বরতার সমস্ত সীমা ছাপিয়ে গিয়েছিল ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়ার ক্ষেত্রে। পূর্ণম ফিরে আসায় যুদ্ধবন্দিদের সেই রক্তাক্ত ইতিহাস মনে পড়ছে দেশবাসীর। বিএসএফ জওয়ান পূর্ণম সাউ কিংবা উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানেরা সৌভাগ্যবান।
পাঠানকোটে কর্মস্থলে পৌঁছেই স্ত্রীকে ভিডিও কল করলেন জওয়ান। একমুখ দাড়ি, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, স্বামীর দশা দেখে কেঁদে ফেললেন স্ত্রী রজনী। বুধ সকাল সাড়ে দশটায় ওয়াঘা পেরিয়ে আটারি সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করেন বিএসএফ জওয়ান পূর্ণমকুমার সাউ। সরাসরি পাঠানকোটে পৌঁছে প্রথমেই স্ত্রী রজনীকে ভিডিও কলে বলেন, “চিন্তা করো না।” রজনী জানিয়েছেন, স্বামী তাঁকে বলেছেন, “আমি ঠিক আছি। দাড়ি কাটতে হবে। পরে কথা বলছি।” ২২ দিন পর স্বামীকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন রজনী। এখন অপেক্ষা ঘরে ফেরার। পহেলগাঁও হামলার পরদিনই উধমপুরে তল্লাশি চালানোর সময় নিখোঁজ হন সেনা জওয়ান পূর্ণম সাউ। পরবর্তীতে জানা যায়, ভুলবশত পাক ভূখণ্ডে ঢুকে যাওয়ায় পাক সেনার হাতে বন্দি তিনি। ২২ দিন পর পাক সেনার হাত থেকে মুক্তি পান পূর্ণমকুমার সাউ। এরপরই মুখ্যমন্ত্রী জওয়ানের স্ত্রীকে ফোন করেন। এক্স হ্যান্ডেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন, “পাকিস্তানে বন্দি জওয়ানের মুক্তির খবর পেয়েছি। আমি খুব খুশি। আমি ওর পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলাম। আগেও ওর স্ত্রী রজনীর সঙ্গে কথা হয়েছে। আজ আবার ফোন করেছিলাম। পূর্ণমকে শুভেচ্ছা। গোটা পরিবার খুব ভালো থাকুক।”
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষবিরতি। বন্দি বিনিময় করল দুই দেশের সীমান্তরক্ষায় মোতায়েন থাকা দুই বাহিনী। ২২ দিন পাকিস্তানে বন্দি থাকার পর অবশেষে মুক্ত বিএসএফ জওয়ান পূর্ণম কুমার সাউ। মুক্তি দেওয়া হয়েছে, বিএসএফের হাতে বন্দি পাক রেঞ্জার্সের সদস্য মহম্মদুল্লাহকেও। পাঞ্জাবের পঠানকোটে কর্মরত বিএসএফ জওয়ান, পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার রিষড়ার বাসিন্দা পূর্ণম কুমার সাউকে আটক করেছিল পাক রেঞ্জার্স। পূর্ণম ভুল করে সীমান্ত অতিক্রম করে পাক ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েন। একটি গাছের নীচে বিশ্রাম নেওয়ার সময় তাঁকে আটক করে পাক রেঞ্জার্স। এই ধরনের ঘটনা ব্যতিক্রমী কিছু নয়। প্রায়ই ঘটে। আর ঘটলে সংশ্লিষ্ট দুই বাহিনী ফ্ল্যাগ মিটিং করে ধৃত সেনা বা আধাসেনা সদস্যকে তাঁদের দেশে ফিরিয়ে দেয়। পূর্ণমের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয়নি। আটকে রাখে পাক রেঞ্জার্স।
একইভাবে ৩ মে পাকিস্তান রেঞ্জার্সের এক সদস্য রাজস্থানে ভুলবশত সীমান্ত লঙ্ঘন করেন এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েন। ভারতের তরফে তাঁকে আটক করা হয় এবং সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, পাকিস্তান আটক বিএসএফ জওয়ানকে ছাড়লেই পাক রেঞ্জার্সের ওই আটক সদস্যকেও ছেড়ে দেওয়া হবে। বেশ কয়েকবার এ নিয়ে ফ্ল্যাগ মিটিং হলেও জট পুরোপুরি কাটছিল না। ১০ মে ভারত ও পাকিস্তানের সংঘর্ষবিরতি ঘোষনায় পূর্ণমের মুক্তি ও বন্দি বিনিময়ের সম্ভাবনা বাড়ে বলে দাবি তথ্যাভিজ্ঞ মহলের। ওয়াঘা-আটারি সীমান্ত দিয়ে ভারতে ফেরেন পূর্ণম। অন্যদিকে, পাক রেঞ্জার্স মহম্মদুল্লাহকেও ছেড়ে দেয় ভারত। প্রোটোকল মেনেই দুই দেশের বাহিনী বন্দি বিনিময় করেছে। নিয়মিত ফ্ল্যাগ মিটিং ও অন্য়ান্য মাধ্যমে লাগাতার যোগাযোগের ফলেই এমনটা সম্ভব হয়েছে।
চরম নির্যাতন করা হয়েছিল স্কোয়াড্রন লিডার অজয় আহুজার ক্ষেত্রে। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। কার্গিল যুদ্ধের সময় মিগ-২১ যুদ্ধবিমান নিয়ে একটি নিখোঁজ মিগ-২৭-কে খুঁজতে গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৯ সালের ২৭ মে পাকিস্তানের একটি ‘সারফেস টু এয়ার মিসাইল’ তাঁর মিগ ২১-কে আঘাত করে। অজয়কে বন্দি অবস্থায় হত্যা করেছিল পাকবাহিনী। তিনি ইজেক্ট করে নামতে পারলেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভারতীয় সেনার অভিযোগ, বন্দি অবস্থায় পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল অজয়কে। পরে সেই দেহ ভারতীয় বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। ২২ বছরের কালিয়া। কার্গিল হাইটসে ৪ জাঠ রেজিমেন্টে দায়িত্বে ছিলেন। কাকসার এলাকায় পাঁচ জন সেনার সঙ্গে নজরদারি চালাচ্ছিলেন। নিয়ন্ত্রণরেখার এপারেই ছিলেন, সেখানে অনুপ্রবেশকারীরা তাঁদের উপর হামলা চালায়। একটানা গুলির লড়াইয়ের মাঝে বুলেট ফুরিয়ে যায় কালিয়াদের। সাহায্য চেয়ে খবর পাঠালেও দেরি হয়। ততক্ষণে ঘিরে ফেলে পাক সেনা। আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন কালিয়া এবং তাঁর পাঁচ সঙ্গী। ২২ দিন আটকে রেখে জেনেভা কনভেনশনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কালিয়ার উপর চলে পৈশাচিক অত্যাচার। সারা গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা, দুই কানের পর্দা ফুটো করে দেওয়া, চোখ গেলে দেওয়া, দাঁত ভেঙে দেওয়া, মাথার খুলি ফাটিয়ে দেওয়া, ঠোঁট ও চোখের পাতা কেটে নেওয়া, হাত ও পায়ের আঙুল কেটে নেওয়া, এমনকী কেটে নেওয়া হয়েছিলো যৌনাঙ্গও। সব শেষে মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল সৌরভ কালিয়া ও তাঁর সঙ্গী পাঁচ জওয়ানকে। পাকিস্তান সেনা ১৯৯৯ সালের ৯ জুন কালিয়ার ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ ভারতকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। বর্বরতা আসলে পাক সেনার চরিত্রেই মানায়।