ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটি কবে লেখা? তারিখ সাল কিচ্ছু জানা যায়নি। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সেই গানের পাণ্ডুলিপিই খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভারতের ৭৮তম স্বাধীনতা দিবসে গানের একটি পাণ্ডুলিপির ছবি পোস্ট করে নোবেল পুরস্কার কমিটি। পাণ্ডুলিপিটি ইংরেজি ভাষায়। শিরোনাম ‘দ্য মর্নিং সং অফ ইন্ডিয়া’। অর্থাৎ ‘ভারতের প্রভাতী’। নোবেল কমিটি জানিয়েছে, ওই ইংরেজি পাণ্ডুলিপি আদতে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটিরই ইংরেজি তর্জমা। রবীন্দ্রনাথ নিজেই ওই গানের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। পাণ্ডুলিপির হাতের লেখাটিও তাঁরই। ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটি ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে নির্বাচিত হয় ১৯৫০ সালে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ন’বছর পরে। গানটি প্রথম গাওয়া হয় ১৯১১ সালের ২৭ ডিসেম্বর। কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের ২৬তম বার্ষিক অধিবেশনে। সমবেত কণ্ঠে গাওয়া গানটির পরিচালনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড় দাদার পৌত্র দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরের দিন ‘দ্য বেঙ্গলি’ পত্রিকায় ওই অধিবেশনের খবরের পাশাপাশি গানটির ইংরেজি অনুবাদও প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্র গবেষকেরাই জানাচ্ছেন, অন্ধ্রপ্রদেশের মদনপল্লিতে গানটির ইংরেজি তর্জমা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর বন্ধু আইরিশ ভাষার কবি জেমস এইচ কাজিন্স বেসান্ত থিওজফিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ। তাঁকে রবীন্দ্রনাথ গানটি বাংলায় গেয়ে শোনান। পরে তাঁর অতিথি হয়ে থাকাকালীনই গানটির ইংরেজি অনুবাদও করেন। কবিগুরুর হস্তাক্ষরে সেই অনুবাদ এখনও ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা আছে মদনপল্লির ওই কলেজের গ্রন্থাগারে। নোবেল কমিটি ভারতের স্বাধীনতা দিবসে তারই ছবি প্রকাশ করে লিখেছে, ‘‘জনগণমন হল ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। যা প্রথমে বাংলায় লিখেছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাঁকে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছিল।’’
উদ্দাম নাচ। চিত্তে হ্যালুসিনেশন। মাদক তৈরি করতে গিয়ে একটুখানি চেখে দেখেই অঙ্গে অঙ্গে তা তা থৈ থৈ। নেপথ্যে পুরুষকণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ গানটি বিকৃত সুরে। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক এ বাংলায় নতুন নয়। যত দিন রবীন্দ্ররচনা কপিরাইটের আওতায় ছিল, তত দিন বিশ্বভারতী সংগীত সমিতির অনুমতি দেওয়া-না-দেওয়া নিয়ে তর্ক উঠেছে নানা সময়ে। সে কপিরাইট উঠে গিয়েছে চব্বিশ বছর আগে, ২০০১-এ। বিশ্বভারতীর অনুমতি নিয়ে এখন আর সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করতে হয় না। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রক্ষণশীলতার কপিরাইট যে বঙ্গচিত্তেরই একান্ত। আশৈশব লালিত রবীন্দ্রজয়ন্তীর স্মৃতি আমাদের বলেই দিয়েছে যথেষ্ট রাবীন্দ্রিক পোশাকেই ও গান গাওয়া যাবে। নির্জন ঘরে নিষিদ্ধ মাদক আর নিপাতনে অসিদ্ধ সম্পর্কের অনুষঙ্গে অবাধ্য মেয়ের হৃদয়ে ও গান কেন? তায় আবার গানের সঙ্গে নাচতে নাচতে এক মেয়ে আর এক মেয়েকে চোখ টিপে দেয়!
রবীন্দ্রসঙ্গীতে যে এক ধরনের ঋষিসুলভ পবিত্রতা আমরা অনেকেই আজও আরোপ করে চলি। রবীন্দ্রসঙ্গীতএ গানের কথায় বেশ মিলে যায় সাহিদা আর প্রীতির অন্তরের গল্প। যেমন মিলে গিয়েছিল ‘চারুলতা’র গল্পও। গিয়েছিল বলেই ওই গানটাকেই ‘চারুলতা’-র থিম মিউজিকে একেবারে টাইটেল কার্ড থেকে ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। সেই নামপত্রে চারুলতা ভূপতির রুমালে ইংরেজি ‘বি’ অক্ষর বুনছে আর নেপথ্যে বাজছে ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে…’। এর পরে গোটা ছবিতে চারুর তথাকথিত ভাল-মন্দের বোধ আর স্ট্যাটিক থাকবে না, দোলাচল তৈরি হবে বন্ধন আর মুক্তির, তারই যেন সুরটি ধরিয়ে দিলেন সত্যজিৎ।
আসলে রবীন্দ্রনাথের গানের স্মৃতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম দু’লাইনের। সে স্মৃতি আমাদের বোকা বানায় মাঝেমাঝেই। যেমন কোনও এক কালীপুজোর কাছাকাছি সময়ে ওই এক-দু’লাইনের স্মৃতি মনে রেখেই হয়তো এক প্রবীণ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কালীপুজোর রবীন্দ্রসঙ্গীত বানিয়ে দিয়েছিলেন ‘নাচ শ্যামা তালে তালে’-কে। অথচ ও গানের শ্যামা, পাখিমাত্র, দেবী নয়। কোথাও কোথাও এখনও শিল্পোৎসবে অবলীলায় ‘নমো যন্ত্র নমো যন্ত্র’ গাওয়া হয়, যে গান আসলে যন্ত্রসভ্যতাকে ব্যঙ্গ করে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের গান কত বিচিত্র মানসিকতার সঙ্গে জুড়ে যায়, মনের কত রকম, কত রকমের মন সে গানে আশ্রয় পায়।
সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের একদম অন্য রকম এক ব্যবহার। জীবনের কিছু রৌদ্রছায়া। কিছু অচলায়তন। নেপথ্যে বেজে চলেছে ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’। বোঝা গিয়েছিল, বাঙালির মুগ্ধললিত অশ্রুগলিত গীত হিসেবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ভাবার অভ্যাসটিকে কী বিপুল ব্যঙ্গ করা হল। আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তের সাম্প্রতিক ‘মায়ানগর’ ছবিতেও এ রকম তির্যক ভাবে এসেছে ‘আলোকের এই ঝর্নাধারায়’। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে কিশোরীমোহন সাঁতরাকে এক চিঠিতে নিজের গান নিয়ে অবাক করা আত্মবিশ্বাসের কথা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, “আমার রচিত গানের সুরগুলি রক্ষা করবার যোগ্য বলেই আমি কল্পনা করি,আমার কাব্যের কোনো কালে অনাদর হতেও পারে কিন্তু বাংলাদেশের লোককে সুখে দুঃখে আমার গান গাইতেই হবে…”। শুধু সুরের জন্য রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর চুরাশি বছর পরেও তাঁর গান বাঙালি গায়, এমনটা তো নয়। তার কথাগুলো আজও অনেক বাঙালিরই মনের কথা হয়ে ওঠে বলেই তাকে আজও রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেই হয়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেই দারুণ ভাবে বেঁচে থাকার আরও প্রমাণ সিনেমায় রবীন্দ্রনাথের গানের এমন সব খোপমুক্ত ব্যবহার এবং তা নিয়ে বিতর্কও।
বাজারে রবীন্দ্রনাথের হেব্বি ডিম্যান্ড। দরকার পড়লে প্ল্যানচেট করেও নামিয়ে আনা হচ্ছে। রবি ঠাকুর নিজে প্ল্যানচেট করতেন জানা আছে। বাঙালির রবীন্দ্রনাথ বিনে গতি নেই। ঝালে-ঝোলে-অম্বলে-বিবাহে-অন্নপ্রাশনে মায় শ্মশানে পর্যন্ত তিনিই। তার পরেও আবার প্ল্যানচেটের কী দরকার। সমাজমাধ্যমের রমরমার সঙ্গে সঙ্গে তাল রেখে পল্লবিত হয়েছে ‘নতুন রবীন্দ্রসঙ্গীত’। র্যাপ রবীন্দ্রসঙ্গীত, রক রবীন্দ্রসঙ্গীত বা তারানা সমৃদ্ধ ধুম-তা-না-না রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে বিতর্কের চাপান-উতর চলত, মূলত বিশুদ্ধতাবাদী আর চলতি হাওয়ার পন্থীদের মধ্যে, সেখানে আপাতত রক্ষণশীলেরা হাওয়া। রিমেক ভার্সনে ‘আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে’, ‘আমি বাংলায় গান গাই’, ‘দেখো আলোয় আলোয় আকাশ’, ‘খোলো দ্বার বঁধুয়া’, ‘কবে তৃষিত এ মরু’ ‘ভালবেসে এত জ্বালা’ সেই সঙ্গে কবীর সুমনের বেশ কিছু গান ইত্যাদি ইত্যাদি।
রবীন্দ্রসুরের অনুসারী বা রবীন্দ্রবাণীর অনুকরণ হলেই সে গান যে রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, এটা বোঝার দায়িত্ব শ্রোতার নিজেরই। গানের বাণী এবং সুরের চলনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আদল রয়েছে, তাই এই বুঝভুম্বুল। ‘আমার ভিতর বাহিরে’ বা ‘আমি বাংলায় গান গাই’-এর ক্ষেত্রে সে কথা কি খাটে? একটু তলিয়ে ভাবতে বসলে মনে হতে পারে, সম্প্রতি বাংলা গানের লিরিকের ছাঁদ থেকে খানিক দূরে অবস্থিত এই সব গান। তার উপর এদের বাণীর মধ্যে রয়েছে এক ধরনের পরিশীলনের ছাপ। রবীন্দ্রসঙ্গীতে দীক্ষিত বা শিক্ষিত শ্রোতারা কখনওই নন, বঙ্গসমাজের খানিক প্রান্তিক অবস্থানের শ্রোতারাই এই কাণ্ডটি করে চলেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের এত বছর পরেও বঙ্গভূমিতে ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ রচনা অব্যাহত। ‘পিরিয়ড পিস’ বা ‘রেট্রো’ নির্মাণের উদ্দেশ্যে এ ধরনের সুর ও বাণীর অবতারণা। ‘রেট্রো’ নির্মাণে রবীন্দ্রনাথই বা কেন?
বাঙালির সুরসৃজনের প্রান্তিক স্টেশন সেই রবি ঠাকুরই। রেট্রো বা বিগত দিনের পটভূমিকায় সিনেমা বানাতে গেলে কেন সরাসরি রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার না করে, তার ছায়ায় লালিত সুরস্পর্শে বানানো গান প্রয়োগ করা হয়, বোঝা কঠিন। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবির অন্তিম দৃশ্যে হাল্লার রাজার কণ্ঠনিঃসৃত সংলাপ “রাজকন্যা কি কম পড়িতেছে?” মনে রেখেই যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত কি কম পড়ছে, তা হলে সত্যিই উত্তর মেলা কঠিন। একটু ছানবিন করলেই দেখা যায়, রবীন্দ্রগানের কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর বাংলা ছবিতে হিন্দিতেও, অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠে ‘কহানি’ ছবির ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ স্মর্তব্য ব্যবহৃত হয়েছে। অনেকগুলিরই প্রয়োগ কতখানি ‘রাবীন্দ্রিক’, তা নিয়ে উস্কোখুস্কো বিতর্কও হয়েছে। কিন্তু মোটের উপর সেই প্রয়োগের আস্য একেবারে বিদায় নেয়নি। রবীন্দ্রনাথের গানের কিসিমে নব্য রবীন্দ্রসঙ্গীত রচনার চেষ্টা? রবীন্দ্রনাথ একটা ঘরানার মতো। আজ মাইহার বা গ্বালিয়র ঘরানা থেকে খানিক সুর তুলে এনে কেউ যদি কোনও গানে প্রয়োগ করেন, তবে কী বলার আছে? রবীন্দ্রনাথের সুর তেমনই অনেকটা। তাই তাঁর সুরের অনুসরণ চললে, তাতে অন্যায় কোথায়? রবীন্দ্রনাথই তো বলে গিয়েছেন, তাঁর বিপুল সৃষ্টিকর্মের কোনও কিছু ভবিষ্যতে না থাকলেও বাঙালি তাঁর গান গাইবেই। এই ‘গান গাইবেই’-এর সূত্র ধরে যদি রবীন্দ্রানুসারী সুরসৃষ্টি ঘটতে থাকে, তাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার কিছু নেই।
জাতীয় সঙ্গীতের ইংরেজি তর্জমা করেছিলেন কবিগুরু, তাঁর হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি প্রকাশ নোবেল কর্তৃপক্ষের মুশকিল হল এখানেই যে, এ হেন ‘অশিক্ষা’র পরিমাণ যে বড় কম নয়, তা সমাজমাধ্যমের পাতা ওল্টালেই মালুম হয়। সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের কোনও কোনও উদ্ধৃতির আগা-লেজা ছেঁটে তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ হিসাবে দেখানোর একটা ঢেউ দেখা গিয়েছে। এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন বিবুধ রবীন্দ্রচর্চাকারীরা। চাপান-উতর অব্যাহত। সমাজমাধ্যম কাজিয়ার ক্ষেত্র হতেই পারে, কিন্তু ভুলকে তো কোনও অর্থেই মেনে নেওয়া যায় না। যেমন মেনে নেওয়া যায় না অর্ধসত্যকেও। রবীন্দ্রসুরের অনুসারী বা রবীন্দ্রবাণীর অনুকরণ হলেই সে গান যে রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, এটা বোঝার দায়িত্ব শ্রোতার নিজেরই।