Sunday, April 20, 2025
spot_imgspot_img

Top 5 This Week

spot_img

Related Posts

বামেদের ‘ঘুরে দাঁড়ানোর’ লড়াই!‌ চমক-কন্যা বন্যাও মাঠ মাতালেন!‌রবিবাসরীয় ব্রিগেডে জনপ্লাবন বাড়তি অক্সিজেন দিতে পারত ‘অগ্নিকন্যা’ মীনাক্ষীর বক্তব্য?‌

বাংলা এবং সাঁওতালি ভাষার মিশেলে বক্তৃতায় নাটকীয় চমক। পো়ডিয়ামে দাঁড়িয়েই জনতার উদ্দেশে বললেন, ‘‘কী কমরেড, ভাল আছেন তো?’’ অজুত কণ্ঠ জানান দিল, ‘হ্যাঁ’। শুনেই বন্যা বললেন, ‘‘কী করে ভাল আছেন? এখানে (রাজ্যে) চোর আর ওখানে (কেন্দ্রে) ডাকাতের সরকার চলছে। আমরা ভাল থাকতে পারি না।’’ তার পর ফের প্রশ্ন, ‘‘ভাল আছেন?’’ জনতা এ বার বলল, ‘না’। ‘‘ক্ষেতমজুর, খেটে খাওয়া মানুষদের লড়াইয়ের কথা শহরের মানুষ জানে না। আমরা শেষ দেখে ছাড়ব। লড়াইয়ের পথ থেকে সরব না।’’ শুধু মঞ্চ থেকে বক্তৃতা করাই নয়, সভা শেষে বাকি কর্মীদের সঙ্গে মাঠ পরিষ্কার করতে হাতে ঝাঁটা নিয়েও নামলেন বন্যা। বাম ব্রিগেড। প্রতিবাদের ব্রিগেড। ২০১১র পর থেকে চলতে থাকা দুর্নীতি রাজ, জনগনের সামনে তুলে ধরার চেষ্টার জনসভা। বামরব, তৃণমূল সরকারের একের পর এক দূর্নীতি জনগনের সামনে। ২০১১ সালে ক্ষমতায়ে আসার পর থেকেই জ্বলন্ত ছবি জনগনের সামনে প্রকাশ পেয়েছে। অর্জুন ফুটবলার সাংসদ হাওড়ার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের টাকা নেওয়ার ছবি প্রকাশ্যে, একে একে সৌগত রায়, মদন মিত্র, ফিরহাদ হাকিম থেকে শুরু করে মমতা সরকারের অন্যতম মন্ত্রী বর্তমানে প্রাক্তন শুভেন্দু অধিকারী সহ আরও অনেকের টাকা নেওয়ার ছবি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছিল। আজও সোস্যল মিডিয়া খুললেই সেই দগদগে ঘা বয়ে বেড়াচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। দুর্নীতির চুড়ান্ত নমুনা জনগনের সামনে নিজেরাই তুলে ধরেছে তৃণমূল নেতা নেত্রী। এরপর লাইন দিয়ে জেলের ঘানি টানার দৃশ্যও সচক্ষে দেখেছেন জনগন। টানা জেল খেটে আসা এক তৃণমূল সাংসদ অশ্রাব্য বুলি ফাঁস করেছিলেন দলের প্রধান নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্কে। ডেলো পাহাড়ে সেই জেলখাটা তৃণমূল নেতার কেলোর কীর্তি জনগন আজও বলতে লজ্জা পান বলে কান পাতলেই শোনা যায়, তৃণমূলের অন্দরেই। প্রিজ ভ্যান থেকে চিৎকার করে জেলখাটা তৃণমূল নেতা সরব হয়েছিলেন, ‘‌মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই দুর্নীতির বিষয়ে সব জানেন। আগে মমতাকে গ্রেফতার করুন।’‌ এখন আবার একাধিক সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখে তৃণমূল সরকারকে ভয় প্রদর্শণ করে তৃণমূলেরই স্ত্রোত্রো পাঠে মগ্ন। জনগন বলছেন, জেলখেটে আসা আসামীর এরকম রঙবদল দেখে খোদ গিরগিটিও লজ্জা পাবে। এরপর, আরজিকর কাণ্ড। নৃশংসভাবে খুন তরুনী ডাক্তার। জড়িত দুর্নীতির আধার সন্দীপ রায়কে আড়াল করার চেষ্টা ও ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় রত এই তৃণমূল সরকার। একজন আসামীকে ‘‌বলির পাঁঠা’‌ করে চটজলদি ফাঁসি দিয়ে দায় সেরে দেওয়ার চেষ্টাও বৃথা হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, বলে জনগনের রব। কারণ খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই নিজ মুখে খুব তাড়াতাড়ি ফাঁসিতে ঝোলানোর কথা বলেছিলেন একাধিবার। আপাতত তা থিতু। এরপর শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক নিয়োগ দুর্নীতি। তৃণমূল সরকারের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর বান্ধবীর খাটের তলা থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার। খোদ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ-‌ই জেলে, জনগন নিজের চোখেই দেখছেন বলে জানিয়েছেন বাম নেতারা। আরজি করের ঘটনায় ছাত্র আন্দোলনের ভয়াবহতায় ভাত হয়েছিল তৃণমূল সরকার। এরপরই শিক্ষক আন্দোলন। একের পর এক দুর্নীতির জটাজালে তৃণমূল সরকার। নোবেলজয়ী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বক্তব্য রেখেছিলেন বিলেতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাম বাহিনীর কথায়, এরপরই আরও এক কবি এপাং ওপাং ঝপাং এর স্রষ্টা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই প্রচার করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখতে চলেছেন। পরে পর্দা ফাঁস। মদ কোম্পানির আহ্বানে স্থানীয় কেলগ কলেজের ক্যান্টিনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যের মাঝে বিপুল প্রতিবাদ। আরজিকর কাণ্ড, ভাওঁতার শিল্প, টাটাকে রাজ্য থেকে তাড়ানোর ইস্যু সামনে রেখে। ব্রিগেডের মঞ্চেও উঠল জনরব। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আবার রুখে দাঁড়াতে মরিয়া জসগন। বাম ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে আশ্বাসবাণী।

বামেদের ব্রিগেড। ভিড় বাম কর্মী সমর্থকদের। বাম সমর্থিত শ্রমজীবী মানুষ ও শ্রমিক সংগঠন, কৃষক সংগঠন, ক্ষেতমজুর সংগঠন। সকাল থেকেই ব্রিগেডে থিকথিকে ভিড়। কাটবে শূন্যের গেরো? বামেদের ‘ঘুরে দাঁড়ানোর’ ব্রিগেড। যোগ দিতে তৎপর বাম সমর্থকরা। সকাল থেকেই। কিংবা রাত থেকেই। আবার কাকভোরে। বাড়ি থেকেই বেরিয়ে হাজির বাম কর্মী সমর্থকেরা। কলকাতা ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড। হাওড়া, শিয়ালদহ, সব স্টেশনেই ভিড়। হাতে লাল ঝান্ডা। রাস্তায় নেমে পড়েছেন বাম কর্মী সমর্থকেরা। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া থেকে হাওড়া, হুগলি, সর্বত্রই একই ছবি। কর্মীরা আসছেন উত্তরবঙ্গ থেকেও। কৃষক, বস্তিবাসী, ও ক্ষেতমজুরদের বিভিন্ন দাবি। চাকরি চুরি ও দিকে দিকে হিংসার প্রতিবাদ। ২০২৬ এর নির্বাচনের রণনীতি ঘোষণা। ব্রিগেডগামী বাম কর্মী সমর্থকেরা আশায়। বাম সমর্থিত শ্রমজীবী মানুষ ও শ্রমিক সংগঠন, কৃষক সংগঠন, ক্ষেতমজুর সংগঠনের সদস্যদের ভিড়ে রবিবাসরীয় ব্রিগেডে জনপ্লাবন। কলকাতায় ছাত্র-যুব-শ্রমিক সংগঠনের সমর্থকরা। সিপিএমের কৃষক, শ্রমিক, খেতমজুর সংগঠনের ডাকেই রবিবার ব্রিগেড সমাবেশ। শূন্যের রেকর্ড করা সিপিএম ঘুরে দাঁড়াতেই বাড়তি অক্সিজেন। ছাব্বিশের নির্বাচনের পরীক্ষা আলিমুদ্দিনের কাছে। সিপিএমের শীর্ষনেতারা সজাগ।

সদ্য কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য সিপিএম যুব সংগঠন ডিওযাই এফআইয়ের-এর রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, বন্যা টুডু থেকে নিরাপদ সর্দার, অনাদি সাহুদের উপস্থিতি। পরিচিত বক্তা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। বক্তা ছ’জন। রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম ছাড়া তালিকায় আছেন কৃষকসভার অমল হালদার, ক্ষেতমজুর সংগঠনের নিরাপদ সর্দার, বন্যা টুডু, বস্তি উন্নয়ন সমিতির সুখরঞ্জন দে, সিটুর অনাদি সাহুরা। মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের নাম না থাকায় বেশ সংশয় যুবদের মনে। ব্রিগেডের মঞ্চে এবারে সিপিএমের মঞ্চের নকশা একটু বদলেছে। ভিক্টোরিয়ার দিকে আগে যে স্থানে মঞ্চ তৈরী হত, সেখান থেকে ৩০০ মিটার এগিয়ে আনা হয়েছে। লম্বায় কিছুটা কমেছে জনসভাস্থলের আয়তন। চব্বিশে ডিওয়াইএফআইয়ের মঞ্চ হয়েছিল পার্ক স্ট্রিটের দিকে মাঠের মাঝখানে। জায়গাও অনেকটা ছিল। জমায়েতও ভালো হয়েছিল। এবার মঞ্চ ভিক্টোরিয়ার দিকে। ৪৮/৩২ ফুট ত্রিস্তরীয় মঞ্চ, মাঝখানে পোডিয়াম। সিপিএম দলের কৃষক, শ্রমিক, খেতমজুর সংগঠনেরর নেতানেত্রীরাই প্রধান মুখ। ২০১১ সালের পর থেকে ভোটবাক্সে ফাঁকা। চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের আগেও যুবদের ব্রিগেডের জনসমাবেশের পর ৪২টির মধ্যে সিপিএম আসন শূণ্য। একুশের বিধানসভাতেও শূন্য। রাজ্য থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর একের পর এক ভোটে বামের ভোট রামে চলে গিয়েছে।

পুলিশের কড়া নিরাপত্তা বন্দোবস্ত। সভাস্থলে মোতায়েন পর্যাপ্ত পুলিশ। মিছিলে নজরদারি পুলিশের। ব্রিগেড সমাবেশে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার ছয়জন আধিকারিক। এসআই ও এএসআই পদমর্যাদার আধিকারিক থাকবেন ১২ জন করে। ৮০ জন পুলিশ কর্মী মোতায়েন। মহিলা পুলিশ ১৫ জন। ডোরিনা ক্রসিং, মেয়ো রোড, চৌরঙ্গি রোডের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ৭টি পুলিশ পিকেটিং। পার্কিংয়ের জন্য ছয়টি জায়গার ব্যবস্থা। দু’টি অ্যাম্বুল্যান্সও। ‌‌ব্রিগেড সমাবেশের মঞ্চে অনুষ্ঠান শুরু। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছেন কর্মী-সমর্থকেরা।‌ বক্তব্য রাখলেন বন্যা টুডু। মিনাক্ষীর নাম বক্তাতালিকায় না-থাকা নিয়ে বামজনতার আক্ষেপ। বন্যা রবিবার বামেদের ব্রিগেডে পুষিয়ে দিলেন। দলের শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর এবং বস্তি সংগঠনের ব্যানারে রবিবার ব্রিগেড সিপিএম বক্তাদের তালিকায় সেলিম ছাড়া কোনও বড় নাম ছিল না। গত কয়েক বছর ধরে যুবনেত্রী মিনাক্ষী বামেদের ভিড় টানেন। আক্ষেপ বাম কর্মী-সমর্থকদের একাংশ। ব্রিগেডের বক্তা তালিকা চূড়ান্ত অথচ সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস মিনাক্ষীকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নাম ছিল না। রবি-ব্রিগেডে ভিড়ের সমবেত প্রতিধ্বনি নতুন কন্যা বন্যার বক্তৃতাতেই। হুগলির আদিবাসী নেত্রী। মিনাক্ষীও ঘনিষ্ঠ মহলে বন্যার বক্তৃতার প্রশংসা। তৃণমূলের ‘খেলা হবে’ স্লোগানের পাল্টা দিলেন বন্যা, ‘‘২০২৬ সালে ওদের উইকেট ফেলে দেব’’, মঞ্চের অদূরে দাঁড়িয়ে করতালি যুবনেত্রী মীনাক্ষীর। বন্যার কথায়, ‘‘সবাই বলে, ব্রিগেডে এত লোক, কিন্তু ভোটবাক্স খালি। মানুষের রুটিরুজির লড়াই আর ভোটবাক্স আলাদা। এখান থেকে ফিরে গিয়ে অঞ্চলে, বুথে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা ভয় খাব না। আমরা কেন ভয় খাব? আমরা তো চুরি করিনি। যারা চুরি করেছে, তারা আমাদের ভয় পাবে।’’

হুগলির গুড়াপের বাসিন্দা বন্যা। তিনি ক্ষেতমজুর সংগঠনের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। সিপিএমের হুগলি জেলা কমিটিরও সদস্য তিনি। নিজেও ক্ষেতমজুরের কাজ করেন বছর ৫০-এর নেত্রী। বাড়িতে রয়েছেন স্বামী, পুত্র এবং পুত্রবধূ। রয়েছে চারটি ছাগল। ছাগলগুলিকে নিয়ে মাঠে রোজ চরাতে যান। মাঠের কাজের ফাঁকে কেটে আনেন ঘাসও। ২০০৩ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত বন্যা ছিলেন গুড়াপের পঞ্চায়েত প্রধান। ২০০৬ সালে সিপিএমের সদস্যপদ পান তিনি। হুগলি সিপিএমের অনেকে বলেন, বন্যাকে আবিষ্কার করেছিলেন দলের অধ্যাপক নেতা তথা প্রাক্তন সাংসদ অধুনা প্রয়াত রূপচাঁদ পাল। রূপচাঁদ দীর্ঘদিন ধরেই ধনেখালি এলাকায় দলের দায়িত্বে ছিলেন।

ব্রিগেড সমাবেশে মাঠ ভরে গিয়েছিল। তবে সেই ভিড় এমন নয় যে কলকাতাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। কৃষক সভার অমল হালদার, সিটুর আনাদি সাহু, বস্তি উন্নয়ন সমিতির সুখরঞ্জন দে, সেলিমেরা বক্তৃতা করেছেন ব্রিগেডে। সেই সভা থেকে রুটি-রুজির লড়াইকে জোরদার করার বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু বন্যার মতো কেউই জনতার কলরব আদায় করে নিতে পারেননি। সিপিএমের এক তরুণ নেতার বক্তব্য, ‘‘কর্মী-সমর্থকেরা পুরনোদের আর সে ভাবে গ্রহণ করছেন না। নতুন চাইছেন। বন্যাদি, নিরাপদদারা আজ এত গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলেন। মিনাক্ষীও যে কারণে ভিড় টানে। মিনাক্ষী বক্তব্য রাখলে জমে যেত।’’ একদা-বিরোধীনেত্রী এক কন্যার উত্থানেই ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল বামেদের ৩৪ বছরের শাসনক্ষমতা। ১৪ বছর আগে। নামতে নামতে শূন্যে পৌঁছে যাওয়া সিপিএম নতুন প্রজন্মের খোঁজে মরিয়া। মিনাক্ষীর মতো মুখেরাই ভরসা। বামেদের নতুন মুখ অগ্নিকন্যাদের দিকেই সিপিএম তাকিয়ে আছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Popular Articles