‘‘সৌগত রায়ের কোনও ক্যারেক্টার (চরিত্র) আছে নাকি? নারদার টাকা নিয়েছিল, মনে নেই? নারদার চোর আর এর-তার থেকে গিফ্ট-নেওয়া সব দু’নম্বরিগুলো এক জায়গায় হয়েছে। দু’নম্বরিদের এক জায়গায় হতে বেশি সময় লাগে না।’’ বললেন সাংসদ। সৌগতকে নারদ গোপন ক্যামেরা অভিযানে অর্থাৎ স্টিং অপারেশন হাতে নগদ টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল। তুমুল গোলমাল তৃণমূলে। অস্বস্তিকর পরিবেশ। লোকসভায় তৃণমূলের সংসদীয় দলের গৃহযুদ্ধ। হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপের লড়াই। চলে এল খোলা ময়দানে। তুমুল যুদ্ধ। এক পক্ষ প্রবীণ সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিন সাংসদকে তীব্র নিশানা লোকসভায় তৃণমূলের মুখ্যসচেতক কল্যাণের। দমদমের সাংসদ সৌগত রায়। বর্ধমান-দুর্গাপুরের সাংসদ তথা প্রাক্তন ক্রিকেটার কীর্তি আজাদকে কটাক্ষ। কল্যাণের নিশানায় মহিলা সাংসদ কৃষ্ণনগরের মহুয়া মৈত্র? নাম করেননি কল্যাণ। ‘এক মহিলা সাংসদ’, ‘ওই ভদ্রমহিলা’। গিফ্ট’ নেওয়ার প্রসঙ্গ। বিদেশে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে উপহার নিয়ে সংসদে আদানি এবং মোদীকে জড়িয়ে প্রশ্ন তোলার অভিযোগে গত মেয়াদের শেষ পর্বে সংসদ থেকে মহুয়াকে বহিষ্কৃত হতে হয়েছিল।
মহুয়ার চিঠি মমতাকে। কল্যাণের দুর্ব্যবহার। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি। মহুয়ার চিঠির প্রসঙ্গে কল্যাণ বলেন, ‘‘আমি সংসদে সকলের বিরুদ্ধে লড়াই করি। একাই লড়াই করি। একটা অধিবেশনে না এলে বুঝবে! ইংরেজিতে ফটরফটর করলেই কোনও পুরুষকে অসম্মান করা যায় না। দিদি যদি মনে করেন আমি ভুল করেছি, বলে দিন। আমি সব ছেড়ে দিয়ে চলে যাব। আমার কী আছে!’’ তৃণমূলের সংসদীয় দলের অন্দরেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। প্রবীণ সাংসদের আচরণে মহিলা সাংসদ লোকসভা সাংসদদের হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপ ছেড়়ে দেন। দলনেত্রী মমতাকে চিঠি। বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য কিছু ভিডিয়ো এবং হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপের স্ক্রিনশট প্রকাশ্যে আনেন। স্ক্রিনশটে কল্যাণ এবং কীর্তির নাম। গৃহযুদ্ধ তৃণমূলের সংদসীয় দলে।
শুক্রে দিল্লির কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনে স্মারকলিপি দিতে গিয়েছিলেন তৃণমূলের প্রতিনিধিরা। তৃণমূলের সংসদীয় দল সূত্রে জানা গিয়েছে, স্মারকলিপিতে প্রতিনিধিদের সইয়ের জায়গায় ওই মহিলা সাংসদ মহুয়ার নাম ছিল না। কমিশনে যেতে বলায় তীব্র আপত্তি। মেজাজ হারান কল্যাণ। কমিশনের দফতরের বাইরে ফুটপাথের উপরেই মহিলা সাংসদকে লক্ষ্য করে অপশব্দ প্রয়োগ করেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের বক্তব্য। তখনই ওই মহিলা সাংসদ সেখানে কর্তব্যরত বিএসএফ এবং সিআইএসএফ জওয়ানদের বলেন, নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। তাঁরা যেন কল্যাণকে গ্রেফতার করেন! কল্যাণ উত্তেজিত। তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন তাঁকে শান্ত হওয়ার আবেদন করেন।
কল্যাণের অভিযোগ নির্বাচন কমিশন থেকে বেরোনোর পরেই ওই মহিলা সাংসদ চিৎকার শুরু করেন এবং কমিশনের সামনে প্রহরারত বিএসএফ জওয়ানদের বলেন, ‘‘এই লোকটাকে গ্রেফতার করুন!’’ কল্যাণের কথায়, ‘‘এত বড় সাহস! আমায় বলছে জেলে ঢোকাবে? আমি ৪০ বছর রাজনীতি করছি। সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ে এই জায়গায় এসেছি। আর কেউ কেউ তো কংগ্রেস নেতার বান্ধবীর পরিচয় নিয়ে রাজনীতিতে এসেছেন! তাঁদের কাছে শিখতে হবে?’’ জেপি মর্গ্যানের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট মহুয়া রাজনীতিতে এসেছিলেন রাহুল গান্ধীর ‘আম আদমি কা সিপাহি’র সদস্য হয়ে। প্রথমে কংগ্রেসে যোগ, পরে তৃণমূলে। ক্ষুব্ধ মহুয়া তখনই কল্যাণের বিরুদ্ধে দিল্লির পার্লামেন্ট স্ট্রিট থানায় হেনস্থার অভিযোগ দায়ের করতে যাওয়ার সময়ে থামানো হয়। তৃণমূল সংসদীয় দলের একটি অংশের বক্তব্য, কল্যাণ অনেক সময়েই মহিলাদের বিরুদ্ধে ‘অসম্মানজনক’ মন্তব্য করেন। এক বার সংসদের সেন্ট্রাল হল-এ এক দলের মহিলা সাংসদ সম্পর্কে প্রকাশ্যেই অপশব্দ প্রয়োগ। মঙ্গলবার কল্যাণ অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি কোনও অন্যায় করেননি। বরং ওই মহিলা সাংসদ তাঁর কন্যার সম্পর্কে অসত্য কথা বলেন কল্যাণের অভিযোগ।
মহিলা সাংসদের পক্ষে প্রবীণ সৌগত বলেন, ‘‘আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। কিন্তু নিশ্চয়ই এমন কিছু হয়েছে, যা ওই মহিলা সাংসদকে অসম্মানিত করেছে। এটা ঠিক নয়। এতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় লোকসভায় দলের নেতা। তিনি খুব অসুস্থ। ওয়াকফ বিল নিয়ে বিতর্ক ছাড়া আর একদিনও সংসদে থাকতে পারেননি। তাঁর অনুপস্থিতিতে যিনি কাজ চালাচ্ছিলেন (লোকসভার মুখ্যসচেতক কল্যাণ), তিনি একটু বেশি ক্ষমতা দেখিয়ে ফেলেছেন। ওর কোনও ক্যারেক্টার নেই। ওর কাজ শুধু এর-ওর পিছনে লাগা। সে দিন এক কথা বলেছিল, আজকে এক কথা বলছে। এর আগে ওই মহিলা সাংসদের বিরুদ্ধে আমার কাছে বলেছিল।উনি শুধু আদানি আর নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে কথা বলেন। বাংলার কোনও বিজেপি নেতাকে কিছু বলেন না।’’
গৃহযুদ্ধ কল্যাণ, সৌগত এবং কীর্তির। ‘দুর্মুখ, অনিয়ন্ত্রিত’ কল্যাণকে মুখ্য সচেতক পদ থেকে সরানোর দাবি সৌগত বলেন, ‘আমি নিশ্চই প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির ঘনিষ্ঠ ছিলাম। কিন্তু ২০০১ সাল থেকে একটানা আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পার্টিতে রয়েছি। তার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন পার্টিতে ছিলেন, ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই কল্যাণকে কোথাও দেখিনি। আমি কিন্তু পার্টির সঙ্গে ছিলাম। ‘নারদার চোর’ বলে আক্রমণ করায় কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লোকসভায় তৃণমূলের মুখ্য সচেতকের পদ থেকে সরানোর দাবি তুললেন দমদমের সাংসদ সৌগত রায়। কল্যাণবাবুকে দুর্মুখ, অনিয়ন্ত্রিত, মানসিক জটিলতা আছে বলেও আক্রমণ করেন
কল্যাণকে মুখ্য সচেতকের পদ থেকে সরানোর দাবি তুলে সৌগত রায় বলেন, ‘দুর্মুখ, অনিয়ন্ত্রিত মানুষ হিসাবে কল্যাণ এর মধ্যেই একটা সুনাম অর্জন করেছে। ও ওর সুনাম নিয়ে থাকুক। কিন্তু আমি মনে করি কল্যাণকে মুখ্য সচেতকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। আসলে এই কদিন সুদীপ অসুস্থ থাকায় কল্যাণের হাতে ক্ষমতা এসেছিল। ও হাতে মাথা কাটছিল। যাকে ইচ্ছে বলতে দিচ্ছিল। বলতে চাইলে লোককে অপমান করছিল। আমার মনে হয় তৃণমূলের সাংসদদের মধ্যে একজনকেও পাওয়া যাবে না যিনি কল্যাণের পক্ষে। এখন ওকে সরানোর ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা সিদ্ধান্ত নেবেন আমরা তা মেনে চলব। কল্যাণের অসহিষ্ণু আচরণের জন্য আমাদের দলের সম্মান ক্ষুণ্ণ হল।’