হিন্দুত্বের উদ্যাপনে অভ্যস্ত। রামনবমী নামক এক বিজাতীয় উৎসব! সংস্কৃতি সততই পরিবর্তনশীল। কালচারাল রিলেটিভিস্ট। আরোপিত প্রথা। নব্য হিন্দুত্বের বিরোধিতা। মৌলবাদী আচরণ। বঙ্গের হিন্দুদের সুরক্ষিত থাকার পথ। উদ্যাপন জরুরি? মানুষ দিব্যি বুঝেছেন। রামের নামে স্লোগান। টুপি খুলিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ বলাতেই হবে। খুব জরুরি। রামনবমীকে কেন্দ্র করে অশান্তির পরিবেশ। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। আশঙ্কা সর্বজনীন। প্রতি বছরই এই উৎসব উদ্যাপনে হিন্দুত্ববাদী সুর চড়েছে। বেড়েছে আস্ফালন, হুঙ্কার। রাজ্যের গৈরিক নেতাদের নানান ভঙ্গিতে প্রকাশ্যেই বিভাজনের বার্তা। অভূতপূর্ব আশঙ্কা। রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। সাম্প্রদায়িকতার সুর চড়ানোর উপলক্ষ। রামনবমীর দিনই। কারণ, বছর ঘুরলেই বিধানসভা নির্বাচনের আগে শেষ রামনবমী। ভোটের বাজার গরম করার সুযোগ। প্রতিবেশী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতায় বাড়তি সুবিধা। সামাজিক স্তরে যেমন সম্ভাব্য অশান্তির আশঙ্কা তীব্রতর। রাজনৈতিক স্তরেও। তৃণমূল কংগ্রেসের রামনবমীর বিপক্ষে বিপজ্জনক রাজনীতি। বিজেপির হিন্দুত্বকে পাল্টা হিন্দুত্বে প্রতিহত করার চেষ্টার রাজনীতি। এ বছরও সে প্রবণতা অব্যাহত। মন ভোলানে সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বানও শোনা গিয়েছে তাদের মুখে। আশঙ্কা প্রকাশ। সম্প্রীতি বজায় রাখার সক্রিয়তা। গণপরিসরে আলোড়ন। গৈরিক
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার নিশ্চিত দায়িত্ব প্রশাসনের। রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত। মিছিল বা উদ্যাপনের অনুমতি না। সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত। গৈরিকপন্থীদের প্রশ্ন, সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকার নেই নিজেদের মতো করে নিজেদের ধর্মীয় উৎসব পালন? গোলমালের আশঙ্কা প্রকট। নতুন করে গজিয়ে ওঠা উৎসব পালনের আকাঙ্ক্ষাকে অন্তত প্রশ্রয় না দেওয়াই বিধেয়। সশস্ত্র মিছিল রামনবমীর বৈশিষ্ট্য। রাজ্যের সীমানা নিয়ন্ত্রণ। অস্বাভাবিক বহিরাগত অনুপ্রবেশ। লাগাতার প্রচার উস্কানিতে পা না দেওয়ার। দায়িত্ব সাধারণ মানুষেরও। সামাজিক-সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা রাজ্যের সার্বিক স্বার্থের প্রতিকূল। ধর্মের রাজনীতি অশান্তির কারণ। ধর্মাবলম্বীরাও অশান্তিরই শিকার। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক সংহতি এখনও তুলনামূলক ভাবে বেশি। সামাজিক স্থিতিশীলতাকে রক্ষা করা রাজ্যবাসীর কর্তব্য। রাম আদৌ এ রাজ্যের পূজ্য দেবতা ছিলেন? তর্কে, উত্তর ভারতীয় গন্ধমাখা রামনবমী এ রাজ্যের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নয়। কোনও দিন ছিল না। সংস্কৃতি আমদানি। সাধু উদ্দেশ্যে নয়। উগ্রতার এই ফাঁদটিকে এড়িয়ে চলা রাজ্যবাসীর কর্তব্য। বঙ্গে নব্য রামের প্রবেশ। বাড়বাড়ন্তের বিষয়টি গুরুতর।
রামনবমীর এই উদ্যাপনের শুরু ২০১৩-২০১৪ থেকে। ভারতবর্ষে রাজনৈতিক পালাবদল। কেন্দ্রে হিন্দুত্বের সরকার। উন্নয়নের গল্প। স্মার্ট সিটি, ডলার মূল্যের হ্রাস, সর্বোপরি দুর্নীতির অবসান, জনমানসে প্রভাব ফেলে। টিমটিম করে শুরু হয় রামনবমী। অচিরেই তার বাড়বাড়ন্ত। প্রতিটি ব্লক স্তরে রামনবমীর মিছিল। অস্ত্র-সহ মিছিল। ধর্মীয় শক্তি, আধিপত্য এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শন। রামনবমী মিছিলকে কেন্দ্র করে প্রাণ গিয়েছে বেশ কয়েক জনের। হিংসা কাউকে রেয়াত করে না। রামনবমী এবং সংগঠিত হিংসার পরম্পরা পশ্চিমবঙ্গে চলতে থাকে এবং দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজো সমেত প্রায় প্রতিটি উৎসবই অতি দ্রুত ‘ওরা আমরা’ ‘হিন্দু মুসলমান’ তরজায় ঢুকে যায়। ২০১৬ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গাচিত্র। প্রতিরোধ ও প্রতিস্পর্ধা। শুরুর দিকের রামনবমীর মিছিলে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের ছবির উপস্থিতি থাকলেও, যত দিন গিয়েছে ততই বাঙালির নিজস্ব পরম্পরা ক্রমাগত ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে হয়ে এক সময়ে মিলিয়ে গেছে। উঠে এসেছে আক্রমণাত্মক হনুমান মূর্তি। গণেশ পুজোতেও সিক্স-প্যাকযুক্ত গণেশ মূর্তি। রামের পতাকা, রামের স্লোগানে হিন্দির আধিপত্য। রামনবমীর মিছিল শুরু হয়েছিল মূলত হিন্দিভাষীদের। মূলত হিন্দিভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল, যেমন জুটমিল সংলগ্ন এলাকা, আসানসোল শিল্পাঞ্চল। ২০২৪-২০২৫ সালে এই মিছিলের উপস্থিতি সর্বাত্মক এবং প্রায়-সর্বজনীন। রামনবমী থেকে ছড়িয়ে পড়া হিংসা সব সময়েই পরিকল্পিত। অস্থিরতা দীর্ঘমেয়াদি।
রামনবমীর মতো উৎসব নানা প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিক প্রয়াস। পশ্চিমবঙ্গে আত্মপরিচয়-কেন্দ্রিক রাজনীতির অবধারিত পরিণতি প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা। প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা দু’রকম ভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে। হিন্দুত্বের সর্বগ্রাসী করাল রূপ। রাজ্যের দু’টি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে প্রভাবিত করে। শুরুর দিকে তৃণমূল কংগ্রেস যেমন রামনবমী মিছিল সংগঠিত করতে চেয়েছে। দিশেহারা হয়ে হনুমান জয়ন্তী এবং পরবর্তী কালে ‘গঙ্গা আরতি’-তে মনোনিবেশ করেছে। দিঘার মন্দির তৈরি করেছে। মুসলমান সমাজ আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চায় শাসক দলকে। এটাই তাদের শেষ আশ্রয়। হিন্দুত্বের বিস্তার দলের হাত ধরেই হোক। হিন্দুত্বপন্থীদের কাছে একান্ত ভাবে কাম্য।
জঙ্গলমহল, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রাম জেলায় রামের উত্থান নাটকীয়। এমনকি ২০২৪-এ প্রাপ্ত ভোট কমলেও বিজেপির প্রভাব এবং হিন্দুত্বের ক্রমবর্ধমান উত্থান। উত্থানের নেপথ্যে হনুমান মন্দিরের উপস্থিতি। জঙ্গলমহলের প্রায় সব গ্রামে বিদ্যমান। মন্দির পরিচালনার জন্যে রয়েছে পরিচালন কমিটি, স্থানীয় দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবার নেবে পুজোর ভার, আর পরামানিক নাপিত পরিবার নেবে ফুল এনে দেওয়া এবং পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব। সন্ধেবেলা রামায়ণ গান কিংবা হনুমান চল্লিশা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে চলে হিন্দু রাজাদের উপর মুসলমান সম্রাটের অত্যাচারের কাহিনি। বর্তমানের কেন্দ্রীয় শাসকেরই ৮০ কোটি হিন্দুর দায়িত্বে। হনুমান মন্দিরের সূচনা জঙ্গলমহল এলাকায় হলেও, কলকাতা-সহ প্রতিটি শহরে, এমনকি জেলা শহরেও এখন এর উপস্থিতি প্রকট, ক্রমবর্ধমান। হনুমানের মূর্তি ও মন্দির গ্রামে গ্রামে আদি অনন্তকাল ধরে চলে আসা চণ্ডী, শীতলা, মনসা, জনজাতি গোষ্ঠীর উপাস্য দেবতা। হনুমানের জন্য তৈরি হয়েছে বেদি। হনুমান পুজোর জন্যে অর্থ সংস্থান। তৃণমূল কংগ্রেসের ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা মোকাবিলার মূল দায়ভার তাদের উপরেই বর্তায়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে তৃণমূলের নমনীয়তা। রামনবমীর উদ্যাপন কিংবা ইসলামিক জলসার সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী কার্যক্রম হিন্দুত্ববাদী দল কিংবা ইসলামিক মৌলবাদের বৃহৎ সংগঠিত শক্তির কাছে তা নিতান্তই অপ্রতুল।
রবিবার রামনবমী উপলক্ষে কলকাতায় সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার পুলিশকর্মীকে নিরাপত্তা দেখভালের দায়িত্বে। সারা রাজ্যে ২৯ জন আইপিএস অফিসার বিশেষ দায়িত্বে। শহরের বুকে পুরনো এবং বড় মিছিলে ডিসি, যুগ্ম পুলিশ অধিকর্তা প্রমুখ পদমর্যাদার আধিকারিকেরা উপস্থিত থাকবেন বলে পুলিশ সূত্রে খবর। ওসি, ডিসি, এসি, জয়েন্ট সিপি-সহ পুলিশের পদস্থ আধিকারিকদের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। মিছিলের জন্য রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ পিকেটিং, ড্রোন, সিসিটিভি এবং ভিডিয়োগ্রাফির মাধ্যমে নজরদারির ব্যবস্থা। রামনবমী উপলক্ষে বিজেপির মিছিল। বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন মিছিলের ডাক। রামনবমীতে পথে নামছে তৃণমূলও। শুধু কলকাতা নয়, আসানসোল, শিলিগুড়ির মতো হিন্দিভাষী মানুষদের বসবাস যেখানে বেশি, সেই এলাকাগুলিতেও মিছিল করবে রাজ্যের শাসকদল। জলপাইগুড়িতে রামনবমীর শোভাযাত্রার আমন্ত্রণ জানিয়ে বাড়ি বাড়ি লিফলেট বিলি করছেন তৃণমূলের কাউন্সিলরেরা। রামনবমীর মিছিলে শহরের রাজপথে অস্ত্র হাতে হাঁটলে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘সিস্টেম’ মেনে মিছিল করা যেতেই পারে। কুইক রেসপন্স টিম তৈরি থাকবে। হেস্টিংস, এন্টালি, কাশীপুর-সহ যে পাঁচ-ছয়টি জায়গায় বড় মিছিল হয়, সেখানে পদস্থ আধিকারিকেরা থাকবেন। বাইকে টহলদারির ব্যবস্থা। মিছিলের সঙ্গে থাকবেন পুলিশকর্মীরা। রামনবমীর দিন কোনও রকম বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং অশান্তি রুখতে বদ্ধপরিকর কলকাতা পুলিশ। হাওড়া, হুগলি, ব্যারাকপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, শিলিগুড়ি-সহ বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের ২৯ জন আইপিএস পদমর্যাদার অফিসার শনিবার থেকেই বিশেষ দায়িত্বে।