‘ইউ আর নট্ দ্য অথরিটি টু টক্ অ্যবাউট স্টেজ। প্লিজ টক টু হেড স্যর।’ ইংরেজীতে জনৈক সঞ্চালকের আবেদনটা ছিল এরকমই। শ্রোতা স্বয়ং স্কুলেরই প্রাক্তন এক ছাত্র বাংলা অর্থ করলেন, তাঁকে নাকি ইংরেজীতে গালাগাল দেওয়া হয়েছে। জনৈক সঞ্চালক পেশায় এক ক্রীড়া সাংবাদিক, ধারাভাষ্যকারও এমনকি এই স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র। তিনি আরও কয়েকটি লাইন বলেছিলেন, যেগুলো শুনে, জনৈক প্রাক্তন ছাত্র দর্শকাসনে বসে থাকা নিজের স্ত্রীকে গিয়ে বলেন, ‘কী বল্লো, বুঝতেই পাল্লুম না, আমাকে বোধহয় ইংলিশে গালাগাল দিলো’। এ যেন পুরানো বাংলা সিনেমার একটা ছোট্ট স্লট?
৬০ বছর পেরিয়ে যাওয়া এক বাংলা মাধ্যমের স্কুল। বর্তমান প্রধান শিক্ষক উদ্যোগ নিয়েছেন পাশাপাশি বাংলা মাধ্যম চালু করার। নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন। কিন্তূ অন্তরায় হচ্ছে কিছু প্রাক্তনীর অশিক্ষাঙ্খিত গা জোয়ারী। বিদ্যালয়ের হীরক জয়ন্তী বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান। অবশ্যই প্রাক্তনীদের ছাড়া সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ৬০বছর পার করা স্কুল থেকে কী একজন ডাক্তার, একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন আইপিএস, একজন আইএএস, একজন আইটি হেড, একজন স্পোর্টস পার্সোনালিটি, একজন প্রিন্সিপাল, একজন জাজ বা প্রথিতযশা প্রাক্তন ছাত্রের খোঁজ মিলল না? যিনি পরিচয় দিতে পারতেন, সত্যিই তিনি শিক্ষার নিকেতনের একজন যথার্থ প্রাক্তনী। হীরক জয়ন্তী অনুষ্ঠানে বিদ্যালয়ের মঞ্চে দ্যূতি দিতেন কেউ একজন প্রাক্তনী ‘ডায়মন্ড’। ৬০ বছরের পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়ার পথে সেরকম কোনও দ্যূতি মিলল?
আবারও প্রশ্ন? তাহলে কী-ই বা মিলল? ওই যে, অনুষ্ঠান মঞ্চের বামদিকে দাঁড়িয়ে মাঝেমধ্যেই উচ্চস্বরে চিৎকার করতে থাকা এক আকণ্ঠ বর্জ্জতরল সেবনকারী প্রাক্তনীর আবেদন ভদ্র-শিক্ষিত মহিলা শিল্পীর উদ্দ্যেশে, ‘একটা গা-গরম করা গান গাইতে হবে’। একবার নয়, একাধিবার! শীতের রাতও আসেনি, তখন ভর সন্ধ্যা! কী অসম্ভব চাহীদা? নিরুপায় সুভদ্রা উচ্চশিক্ষিতা সুপরিচিত সঙ্গীতশিল্পী একটু ভদ্রতার খাতিরেই মস্করা করে বিষয়টি উড়িয়ে দিতে চাইলেও, নাছোড়বান্দা জনৈক প্রাক্তনী। শেষমেস মহিলা শিল্পীর সোজাসাপ্টা উত্তর ‘ আমি গা গরম করা গান গাই না, গাইতেও পারবো না। যেটা আমার গান সেটাই গাইছি শোনো’ আবারও প্রশ্ন উঠছে, এটা তো স্কুলের অনুষ্ঠান? তাহলে আকণ্ঠ হয়ে নাচাগানা...., এটা তো স্কুল কালচারে পড়ে না?
সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই শিক্ষার জগৎ?
পরের প্রশ্ন? স্কুলের হীরক জয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে সাধারনত ‘প্রধান শিক্ষক’ই শেষ কথা বলেন বলেই শিক্ষামহল জানেন। কিন্তূ শিক্ষার নিকেতনে উল্টো পূরাণ? ওই ধরনের ‘তথাকথিত’ প্রাক্তনীরা স্কুলের নাচাগানা গা-গরমের অনুষ্ঠানের জন্য দিনরাত এক করে অনেক টাকা তুলেছেন, সুতরাং আশি শতাংশ তাদের দাবি মেটাতে হবেই! কী বিচিত্র এই আবদার? ফাঁপরে হেডমাস্টার! ধরি মাছ না ছুঁই পানি? অনুষ্ঠানের সামনের সারিতে কারা থাকেন? ওই যে সারা বছর ধরে স্ক্র্যপ লোহার নাড়াচাড়া সামলানো, রাস্থার পাড়ে ম্যাটাডোর স্ট্যান্ডে সারাদিন বসে থাকা ব্রোকারী সামলানো, র্যাঁদা সামলানোর পাশাপাশি জীবের ডগায় অশ্রাব্য গালাগাল লেগে থাকা প্রাক্তনী। হীরক জয়ন্তী অনুষ্ঠানে, সরকার নিষিদ্ধ গুঠখা সেবন করা দন্ত বিকশিত করে, প্রাক্তন শিক্ষক মহাশয়ের থেকে একটু আশির্বাদ প্রার্থণা। ইতস্তত প্রাক্তন শিক্ষক নিরুপায়। জিজ্ঞাসা করতেই দ্বিধাগ্রস্থ স্বয়ং ‘স্যর’, ‘ছাত্র-বাবাজীবন, তুমি এখন করো টা কী?’ ওই যে সিংহভাগ অনুষ্ঠানের গুরুদায়িত্ব নিয়ে উদ্ধার করছেন বিশাল ‘নাচা গানা’র অনুষ্ঠান। না! এই প্রশ্ন করতে পারেন না ‘স্যর’, কারন সব ছাত্রই তাঁর কাছে সমান। আরও আছে? এক প্রাক্তন ছাত্র তিন হাজার টাকা নাকি চাঁদা দিয়েছেন, আবার কেউ কেউ চার কিংবা পাঁচ বলে অভিযোগ? বাতাসে এসে টাকা নিয়ে চলে গেল, কিন্তু কোনও রসিদ পাননি প্রাক্তনী! আবার ‘বিশ্বখ্যাত’ চোরের মায়ের বড় গলা? অথচ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলছেন, রসিদ ছাপা হয়েছে! তাহলে এতো আনন্দ আর আয়োজনের উৎসাহ কোথায়? এরকম অলিখিত ঠিক কতটা পরিমান টাকা উঠেছে? আদৌ খুঁজতে চেষ্টা করবেন প্রাক্তন ছাত্ররা ও শিক্ষকরাও?
এবার প্রশ্ন? স্কুলের হীরক জয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে ছোট্ট সুন্দর মঞ্চ সাজিয়ে, সাংস্কৃতীক জগতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা খ্যাতনামা প্রাক্তনীদের নিয়ে মনোমুগ্ধকর সুশীল সামাজিক অনুষ্ঠান করা কী সম্ভব হত না? কিংবা, প্রাক্তনীদের অনেকের সন্তান থাকতেও তো পারেন, সেলেব জগতের আগামী প্রতিভা? সুশীল, উচ্চ শিক্ষিত প্রাক্তনীদের পরিবারে এরকম প্রতিভা নিশ্চয় খুঁজে বের করা যেতেই পারতো? হয়তো তাতে গা গরম হবে না। কিন্তু, মনের মণিকোঠা উষ্ণতায় পূর্ণ থাকবে। এবং তা গেঁথেও থাকবে অনন্তকাল। খরচাও এতো আকাশ ছোঁয়ার সম্ভাবনাই নেই।
শেষ প্রশ্নেই রয়েছে গুচ্ছ? আগামীতে শতবর্ষের অনুষ্ঠান! কোনওভাবে আমূল পরিবর্তন সম্ভব হতে পারে বলে মনে হয়? কালের অমোঘ নিয়মে অর্থাস্বার্থান্বেষীদের ভ্রুকুটি থেকে নিষ্কাষন কোনওভাবে সম্ভব? যাদের কাছে সম্মান, উচ্চশিক্ষা, সামাজিক স্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত প্রাক্তনীদের থেকেও মূল্যবান লালসামিশ্রিত ‘অর্থ’সম্বলিত প্রাক্তনী! ইংরেজী মাধ্যম হতে চলেছে বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি। তাহলে, বাংলা কঠিন ভাষা সমন্বিত ‘গালমন্দে’ সুঅভ্যস্থ ‘অ-না-ধি-শিক্ষিত’ প্রাক্তনীদের কী হবে? কারণ, যার আটে হয়নি, হুট করে আশিতেও হবে না, নিশ্চয়? শতবর্ষের লগ্নে কী কোনও ভাবে খুঁজে বের করা সম্ভব, সেইসব প্রাক্তনীদের, যারা সত্যিই সুউচ্চবর্গের সামাজিকতায় সুপ্রতিষ্ঠিত? এইরকম প্রাক্তনীদের অন্বেষনে এনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। অনুষ্ঠানের ছুতো শুনলেই প্রথিতযশা প্রাক্তনী দিবারাত্র এক করে দৌড়তে থাকেন না? তবে, খুঁজে পাওয়া গেলেও, তিনি কী পাবেন দীর্ঘদিন নিজের অর্জিত শিক্ষার আলোর বিচ্ছুরণ করে নিজের অর্জিত সম্মান রক্ষা করতে? অন্তহীন প্রচেষ্টায় লিপ্ত স্কুলের ‘হেডস্যার’ পারবেন এরকম ‘ডায়মন্ড’ প্রাক্তনীর যথার্থ সম্মান রক্ষা করতে? অসম্ভব কিছু নয়! তবে, মাননীয় ‘হেডস্যার’ মহাশয়কে হতেই হবে বজ্রকঠিন। পিছন থেকে আসা ঝড় ঝাপটা সামলাতে অতি প্রয়োজন একটা ‘রিয়েল হার্ড-স্পাইন’!
আওয়ার হেডমাস্টার ‘হি ইজ দ্য লাস্ট ওয়ার্ড অব দ্য স্কুল এন্ড হি উইল বি দ্য লাস্ট ওয়ার্ড অব দ্য স্কুল’ ?